যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ আজকের বিশ্বে অন্যতম আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ঘটনা। দুই মহাশক্তির অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব শুধু তাদের নিজস্ব অর্থনীতিতে নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায়ও গভীর প্রভাব ফেলছে। এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয় ২০১৮ সালে । তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন, যার ফলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। সেই থেকে এই দ্বন্দ্ব ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
২০১৯ সালের মধ্যে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ বৃদ্ধি পাওয়ার পর, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উভয় পক্ষ একটি উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায় শেষ করে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রথম চুক্তিতে পৌঁছেছিল। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ের শেষের দিকে চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে পুরোপুরি না পেরে উঠাকে ব্যাপকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তার উত্তরসূরি জো বাইডেন এর আমলে চীনের বিরোধিতা দেখা গেলেও চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ ততটা দেখা যায়নি। চীনের সাথে বাণিজ্যেও তিনি অবশ্য শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে রেখেছেন।
আগামীতে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প আবারও বিজয়ী হলে এ বাণিজ্য যুদ্ধ আবারো নতুন করে শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই এর পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে ট্রাম্প শিবির নির্বাচনী প্রচারণার সময় চীনা পণ্যের উপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ভাবছিল।
বাণিজ্য যুদ্ধের মূল কারণ
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের মূল কারণগুলো বহুমুখী। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা। দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রচুর পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করছে কিন্তু মার্কিন পণ্যের চীনে প্রবেশ সীমিত করছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সঙ্গে প্রায় ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় এক বিশাল চাপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত চুরি এবং মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন বাণিজ্য যুদ্ধের আরেকটি বড় কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন তাদের প্রযুক্তি চুরি এবং মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের মাধ্যমে নিজেদের প্রযুক্তি খাতকে সমৃদ্ধ করছে, যা মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। ট্রাম্প প্রশাসন এই কারণেই চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যার মধ্যে হুয়াওয়ে এবং জেডটিই বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সরবরাহ শৃঙ্খল, বিনিয়োগ, এবং উৎপাদন খাত সহ নানা ক্ষেত্রেই এই সংঘর্ষের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতি, যা মূলত গ্লোবালাইজেশনের ওপর নির্ভরশীল, দুই দেশের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবেই বিশ্ব অর্থনীতির উপর পড়েছে কেননা এ দুই দেশউ বিশ্ববাণিজ্যে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তারকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন উচ্চমানের প্রযুক্তির সরবরাহকারী। বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের বহু বহুজাতিক কোম্পানি চীন থেকে তাদের উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, আবার চীনা অনেক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে এসে নিজের দেশের উন্নয়নে দেশে এসে তাদের ব্যবসা ও কোম্পানির স্থাপন করছে ।কিন্তু এতে সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং পণ্য সরবরাহে বিলম্ব দেখা গেছে, যা বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
দুই দেশের বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিনিয়োগের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।যদিও বিনিয়োগ এখনো হচ্ছে, তবে দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্য উত্তেজনা বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ইউএস চায়না বিজনেস কাউন্সিলর হিসেবে চীনে যেসব আমেরিকান উদ্যোক্তা কাজ করছে তাদের মধ্যে ৮১% মনে করেন বাণিজ্য যুদ্ধ তাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অথচ ২০১৭ সালে মাত্র ৪৫% আমেরিকান কোম্পানির এ ধরণের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ ছিলো।
বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে অন্যান্য বাজারের দিকে ঝুঁকছে, যা বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
আবার ,যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাত চীনের ওপর বেশ নির্ভরশীল ছিল, বিশেষত সয়াবিন এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করেছিল, যার ফলে মার্কিন কৃষকদের জন্য বিশাল আর্থিক ক্ষতির সৃষ্টি হয়েছিল। চীন এসময় তাদের সংকট মোকাবেলায় বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকেছিল, যা মার্কিন কৃষি খাতে এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে প্রযুক্তি খাতে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করে, বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এর ফলে চীন তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি উৎপাদন এবং উদ্ভাবনের ওপর জোর দিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সম্ভাবনা এবং ইতিবাচক প্রভাব
যদিও বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তবুও এটি কিছু সম্ভাবনা এবং উদ্ভাবনী সুযোগ তৈরি করেছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি চীন থেকে তাদের উৎপাদন সরিয়ে নিয়ে বিকল্প বাজারে চলে গেছে, যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, এবং মেক্সিকো। এর ফলে এই অঞ্চলগুলোতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেড়েছে। বর্তমানে একমুখী অর্থনীতিতে এ মেরুকরণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ । দীর্ঘমেয়াদে এই পরিবর্তনগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তৈরি করতে পারে।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে চীন তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ওপর আরও মনোযোগ দিচ্ছে। চীন তাদের প্রযুক্তি খাতকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে। এর ফলে, চীনের প্রযুক্তি খাত দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে নতুন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলো তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছে। এ ধরনের নতুন বাণিজ্য চুক্তি বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ভবিষ্যত কী হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে দুই দেশ একটি সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। কারণ তারা আশঙ্কা করেন যে এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ব অর্থনীতি আরও বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তবে অন্যপক্ষ মনে করেন যে বর্তমানের বিশ্ববাণিজ্যকে একমুখী দিক থেকে সরিয়ে এনে অন্যান্য দেশকে সুফল পাইয়ে দিতে মেরুকরণ দরকার অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ থাকা আবশ্যক ।
যদিও উভয় পক্ষই শুল্ক এবং নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে, তবুও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে আরও উদার বাণিজ্য চুক্তি করতে পারে, যেখানে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চুরি এবং মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের বিষয়টি সমাধান করতে পারে।
নতুন চীন-মার্কিন চুক্তিতে যা থাকছে
চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে ২০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে যাবে, যা ২০১৭ সালের সমপরিমান হবে। কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়াবে ৩২ বিলিয়ন ডলার, শিল্পপন্য আমদানি করবে ৭৮ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ আমদানি ৫২ বিলিয়ন ডলার এবং সেবাখাতে চীন আমদানি করবে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়াও নকল ঠেকাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছে চীন। আর ট্রেড সিক্রেট চুরির ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করবে। ৩৬০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। অপরপক্ষে চীন, ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক কাঠামো পুনঃবিন্যাস করবে।
পরিশেষে বলা যায় , যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে শুরু করে বিনিয়োগ প্রবাহ এবং কৃষি খাত পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই এই সংঘর্ষের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। তবে বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্রের উদ্ভব এবং চীনের প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করেছে এই বাণিজ্য যুদ্ধ। ভবিষ্যতে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলাফল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে এবং এই দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য কূটনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য হয়ে উঠছে।