বাংলাদেশের পোশাক খাত, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে, বর্তমানে রপ্তানি সংকটে রয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ইউরোপের বাজারে দেশের পোশাক রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস দেখা গেছে। ইউরোপের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় এই পতনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পোশাক রপ্তানি কমে ১২ দশমিক ৯০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। বাংলাদেশ, ইউরোপের বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, চলমান সংকটের ফলে রপ্তানিতে এই বিপর্যয় ঘটেছে।
ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে। ফলে ভোক্তারা তাদের পোশাক ক্রয়ের অভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে, যা সরাসরি রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। এই আমদানি হ্রাসের পেছনে শুধু বাংলাদেশের রপ্তানিই নয় বরং চীন, তুরস্ক, ভারতসহ প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও একই ধারা দেখা গেছে।
চীন, যা ইইউতে সর্বাধিক পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, তাদের রপ্তানিতে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের রপ্তানিতে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ হ্রাসের ফলে তাদের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতও রপ্তানিতে পতনের শিকার হয়েছে, তাদের রপ্তানি ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানিতে বড় ধরণের প্রভাব ফেলেছে। জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক উত্তেজনা, ছাত্র আন্দোলন এবং ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। অগ্নিসংযোগ ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, যা সরাসরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, শুধুমাত্র শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী এই অস্থিরতা রপ্তানিকারকদের অনেককে সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ করেছে। ফলে বিদেশি ক্রেতারা দ্রুত ডেলিভারির জন্য অন্য দেশে অর্ডার স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছেন। বিদেশি ক্রেতাদের কিছু প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা স্থগিত করেছে, যা শিল্পের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি, বিশ্বব্যাপী পোশাক রপ্তানি ক্ষেত্রে সংকট দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকোচনের দিকে নিয়ে গেছে। এর ফলে ইইউ ভোক্তাদের মধ্যে পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এমনকি ইউরোপের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেও, এখনও বাজারে সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি।
তবে কিছু দেশ রপ্তানিতে সফল হয়েছে। কম্বোডিয়া, পাকিস্তান এবং মরক্কো তাদের রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখিয়েছে। কম্বোডিয়া ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, পাকিস্তান ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে এবং মরক্কো ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্য অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং শ্রমিক অসন্তোষের সমাধান হলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুনরায় স্থিতিশীল হবে। এর পাশাপাশি, নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন এবং টেকসই উৎপাদন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এই খাতকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউরোপীয় বাজারে চাহিদা কিছুটা পুনরুদ্ধার হতে শুরু করলেও, এটি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। তবে বাংলাদেশের শিল্পখাত যদি দ্রুত প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে ফিরতে পারে, তাহলে রপ্তানির হার আবারও ঊর্ধ্বমুখী হবে।