রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ব্রিকস সম্মেলনে নতুন একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা তৈরির অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ২২ অক্টোবর ২০২৪, রাশিয়ার কাজান শহরে শুরু হওয়া তিন দিনের এই সম্মেলনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটি ইউক্রেনে রুশ বাহিনী প্রবেশের পর থেকে মস্কোর সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক আয়োজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে থেকেও পুতিন এই সম্মেলনের মাধ্যমে রাশিয়াকে বৈশ্বিক পরিসরে আরও কার্যকর অবস্থানে নিয়ে যেতে চান। পুতিনের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে, পশ্চিমাদের রাশিয়া বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, “একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং এটি থামানো যাবে না।”
ব্রিকসের এবারের সম্মেলনে চীন, ভারত, তুরস্ক, ইরানসহ প্রায় ২০টি দেশের নেতারা অংশ নিয়েছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থার নতুন কাঠামো তৈরি এবং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত নিরসনের পথ খোঁজা। রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে, ব্রিকস জোটটি পশ্চিমা প্রভাবের জি-৭-এর বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, যা তাঁর দুই বছরের মধ্যে প্রথম রাশিয়া সফর। পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর জোর দেন এবং তাদের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বের কথা বলেন। বিশেষত, রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্বকে তিনি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।
সম্মেলনের আয়োজক শহর কাজানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জোরালো। সম্মেলনে যোগ দেওয়া প্রতিনিধিদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে রাশিয়া তাদের কূটনৈতিক উপস্থিতি শক্তিশালী করার ইঙ্গিত দেয়।
২০০৯ সালে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন মিলে গঠিত ব্রিকস জোটে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে জোটটি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।
সম্মেলনে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর সঙ্গে পুতিন পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকে পশ্চিমাদের প্রভাব মোকাবিলা ও ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গেও পুতিনের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে, তবে রাশিয়ার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার পুতিনের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আলোচনায় ইউক্রেন সংঘাতের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। তবে কিয়েভ ইতিমধ্যেই গুতেরেসের এই সফরের বিরোধিতা জানিয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনো সংঘাতের সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে হওয়া উচিত এবং দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে আমরা সমর্থন করি।” রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মোদি শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূমিকা স্পষ্ট করেন।
সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর সঙ্গে পুতিন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক লেনদেন এবং ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, “ব্রিকস বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।” তিনি আরও বলেন, এবারের সম্মেলন বিশ্বের সামনে আরও ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরির সুযোগ এনে দিয়েছে।
ব্রিকস সম্মেলন শুধু বৈশ্বিক রাজনীতির মঞ্চেই নয়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।