বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের পর আমানতকারীদের মধ্যে ফিরে আসা আস্থার ফলশ্রুতি। রাজনীতি নিয়ে চলমান পরিবর্তনগুলি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করেছে। তবে, উদ্বৃত্ত তারল্যের এই বৃদ্ধির মধ্যেও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ব্যাংকগুলোতে তারল্য বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৬টি ব্যাংক অতিরিক্ত তারল্যের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে চারটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক এবং ৪২টি প্রথাগত ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত। উদ্বৃত্ত তহবিলের শীর্ষে রয়েছে সোনালী ব্যাংক, যার পরের অবস্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, আমানতকারীরা সরকারি ব্যাংকগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তারা মনে করেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে তাদের কষ্টার্জিত অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, যেমন এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো ও সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে বড় আকারের ঋণ খেলাপির কারণে তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সার্বিকভাবে ব্যাংকখাত স্থিতিশীল রয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাংক বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট তারল্য ধরে রেখেছে। তবে, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাহাদ আবদুল মান্নান বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী অবস্থানের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, এ নীতির উদ্দেশ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
এছাড়া, উচ্চ সুদের হার এবং স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামাও উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুঁজতে নিরুৎসাহিত করছে। এর ফলে, অনেক ব্যাংক তাদের অতিরিক্ত তারল্য সরকারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করছে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক অধিগ্রহণের পূর্বে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা মান্নান আরো উল্লেখ করেন যে, বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের দিকে ঝুঁকছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের অধিকাংশ ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো মানসম্মত ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ট্রেজারি ইনস্ট্রুমেন্টে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। তিনি আরও জানান, ব্যাংকের বাইরে প্রচলিত নগদ অর্থ কমছে, আর প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার বৃদ্ধির ফলে আমানত বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনেয়ারা শিখা জানিয়েছেন, শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। এই কারণে, ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে, ব্যাংকখাতে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য আশাব্যঞ্জক একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে।