মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে আসতে পারে। এই পূর্বাভাস তেল বাজারের অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জেপি মরগ্যানের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, আগামী এক বছরে তেলের দাম ওঠানামা করবে। চলতি বছরের শেষ প্রান্তিকে তেলের দাম ৮০ ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু ২০২৫ সালের শেষ দিকে তা আবার ৬০ ডলারে নেমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই অস্থিরতার প্রধান কারণ পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। এই উত্তেজনা শুধু তেলের বাজারকেই নয় বরং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা স্থিতিশীল ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ছিল ৭১ ডলার, যা অক্টোবরের শুরুতে ৮১ ডলারে পৌঁছায়। কিন্তু চাহিদার উদ্বেগের কারণে পুনরায় দাম ৭৩ ডলারে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির চাহিদা হ্রাস পাওয়ার ফলে তেলের দাম বৃদ্ধির তেমন সুযোগ নেই। অর্থনীতির এই চাহিদা-জোগানের সম্পর্কেই তেলের দাম বাড়া বা কমার প্রেক্ষাপট নির্ভর করে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে চীন, যার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। চীনের প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাওয়ার কারণে সেখানে তেলের চাহিদা কমে যাচ্ছে। বছরের প্রথম ভাগে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনের তেল আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। চীনের তেল মজুতের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে বাজারে ইতোমধ্যে স্থিতিশীলতার অভাব দেখা দিয়েছে, যা তেলের দাম কমানোর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জেপি মরগ্যানের গ্লোবাল কমোডিটি স্ট্র্যাটেজিস বিভাগের প্রধান নাতাশা কানেভা বলেছেন, পশ্চিম এশিয়ায় চলমান সংঘাতের সমাধান না হলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে ওপেক এবং সহযোগী দেশগুলো, যারা এত দিন উৎপাদন হ্রাসের পথে ছিল, শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দাম কমতে শুরু করবে।
রাবোব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বাজারে দৈনিক প্রায় সাত লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত সরবরাহ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অতিরিক্ত সরবরাহ তেলের দামকে নিম্নমুখী করতে সহায়ক হবে। ২০১৭ সালের পর বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মজুত বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তবে ব্রাজিল এবং গায়ানা থেকে অতিরিক্ত সরবরাহের আশা থাকায় বাজারে চাপ কমবে।
ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্বের কারণে যদি হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি পরিবহন পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তেলের দাম বাড়তে পারে। এদিকে, এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) ২০২৫ সালের জন্য বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের চাহিদার পূর্বাভাস কমিয়েছে। তারা দৈনিক চাহিদা তিন লাখ ব্যারেল হ্রাস করে ১০ কোটি ৪৩ লাখ ব্যারেলে নিয়ে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জন্য চাহিদার বৃদ্ধির পূর্বাভাসেও সংশোধন করেছে। তেল বাজারের এই অস্থিরতা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলবে এবং তা জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সুতরাং, আগামী বছর জ্বালানি তেলের বাজারের জন্য নতুন করে দুশ্চিন্তার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৃহৎ অর্থনীতির চাহিদার হ্রাসের প্রেক্ষাপটে।