বাংলাদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা যেন একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশের অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। তবে, সরকার এবার এই সমস্যা সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নতুন উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, মানি লন্ডারিং মামলা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে অন্তর্ভুক্তকরণ, সরকারের কৌশলপত্রের বাস্তবায়ন, ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেনের বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) চুক্তি স্বাক্ষরের কার্যক্রম। এছাড়া, পাচারের তথ্য চেয়ে পাঠানো চিঠির জবাব পেতে সমন্বয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এই সিদ্ধান্তগুলো জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে তুলে ধরেন। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২২ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক করেন কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের চলমান বৈঠকে বাংলাদেশের টাকা পাচারের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, পাচারের অর্থ ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিকমানের বেসরকারি এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হবে। পাচার হওয়া টাকার ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনগত সহায়তা নেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।
সাম্প্রতিক বৈঠকে জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্যরা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, দুদকের তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে মানি লন্ডারিং মামলা যুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বর্তমানে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত মামলার আওতায় দুদক কিছু অপরাধের তদন্ত করতে অক্ষম। এ বিষয়ে দুদকের সচিব একটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং পরবর্তী বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়ে থাকে। এসব অর্থ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বিভিন্ন দেশে চলে যায়।
জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়েছে, উল্লিখিত দেশগুলো থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে এমএলএ চুক্তি স্বাক্ষরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে এই চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারের আগের কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু আগের সরকার এই কৌশলপত্রের বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান সরকার এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, পাচার হওয়া সম্পদ জব্দ করে দেশে ফেরত আনতে ছয়টি সংস্থা কাজ করছে। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
অর্থ পাচারের অভিযোগে অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর কেবল দুইবার অর্থ ফেরত আনার নজির রয়েছে। একটি হলো, সিঙ্গাপুর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকা ফেরত আসা এবং অন্যটি হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার ফেরত পাওয়া।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ সরকারের এই নতুন উদ্যোগগুলো বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার এবং ভবিষ্যতে অর্থ পাচার রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সরকারের এই প্রচেষ্টার সফলতা হলে দেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, যা দেশবাসীর জন্য সুখবর বয়ে আনতে পারে।