বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আজকাল ভয়াবহ অস্থিরতার ছাপ পড়ছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলার ও জ্বালানির সংকটের পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও চলছে টানা দরপতন। এমন অবস্থায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত লোকসানের মুখে পড়ছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত ফেরত না পাওয়ায় হতাশ গ্রাহকরা ক্ষোভে শাখা তালাবদ্ধ করছেন। আমদানি নীতির কড়াকড়ি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট এবং তারল্য সংকটে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি একপ্রকার থমকে গেছে। এ যেন এক অভাবনীয় সংকটে পড়ে গেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে নীতি নির্ধারকদের এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু শ্রম অসন্তোষ থেকে শুরু করে ঋণের ওপর উচ্চ সুদ—এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উৎপাদনমুখী শিল্প লোকসানে পড়েছে। তারল্য সংকট সামাল দিতে সুদের হার বাড়ানো হলেও বাস্তবে তা তেমন কোনো ফল আনছে না বরং এতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ব্যবসা চালানোই কঠিন হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে আগের বছরে এটি ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ বছরের শুরুতেই প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্প ও সেবা খাতের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। চলতি বছরের জুনে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে এটি ছিল ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেবা খাতেও দেখা গেছে প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা। সরকারের নির্দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পর গত বছর থেকে তা বাড়ানো হয়। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে আরেকটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পাচ্ছেন না, ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাধ্য হচ্ছেন। ডলার সংকটের প্রভাবেও আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সামগ্রিক আমদানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। একদিকে জ্বালানি সংকট, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় দেশের শিল্পখাতে মন্দা দেখা দিয়েছে, যা সার্বিক অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলেছে।
এদিকে, শেয়ারবাজারেও চলছে টানা দরপতন। নতুন কমিশনের অধীনে গত ১৮ আগস্ট থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে, যার প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা পুঁজির বড় অংশ হারিয়েছেন। ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের উচ্চ সুদের দিকে ঝুঁকছেন, ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমে গেছে।
একই সময়ে অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনও ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। খাদ্যসামগ্রীতেও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার উন্নয়ন ব্যয়ও কমিয়ে দিয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় না হলে কোনো প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে না, ফলে অবকাঠামো খাতেও কার্যক্রম কমেছে।
এই অস্থির সময়ের মধ্যে দেশবাসীর জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।