বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংক বর্তমানে এক আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। আর সেই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রূপসী গ্রুপ, যারা ২০০৮ সালে প্রথম এই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু এই ঋণ কখনই সহজে পরিশোধিত হয়নি; বরং বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে টানা ঋণ পুনঃতফসিল করে চলেছে গ্রুপটি। সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার অর্ধেকের বেশি ঋণ এখন শুধুমাত্র এই গ্রুপের কাছেই আটকে রয়েছে। সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, রূপসী গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির বকেয়া ৪৬৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের জন্য এক বিশাল দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক দুটি তদন্তে দেখা গেছে, রূপসী গ্রুপের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে একাধিকবার ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপসী গ্রুপকে প্রায় ১৫০ শতাংশ ফান্ডেড লোন সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা একেবারেই নিয়মবহির্ভূত। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং রূপসী গ্রুপের মধ্যে যোগসাজশের মাধ্যমে এই সুবিধাগুলো দেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংক গ্রাহকের রপ্তানি বিল থেকে ঋণ আদায় না করে সেই অর্থ গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছে, যা ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করেছে।
রূপসী গ্রুপ গত ১২ বছরে সাতবার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। তবুও ঋণ পরিশোধে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে, যা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্যাংকের আর্থিক সংকটের জন্য এখন দায়ী হয়ে উঠেছে এই ঋণ পরিশোধ না হওয়ার ঘটনা।
তদন্তে আরও উঠে আসে যে, রূপসী গ্রুপের বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। যদিও প্রায় ৪৪১ কোটি টাকার সম্পত্তি জামানত রাখা হয়েছে। তবে তদন্তে দাবি করা হয়েছে যে, ব্যাংক সঠিক মূল্যায়নের অভাবে বড় ধরনের জামানত ঘাটতির সম্মুখীন। মোশাররফ হোসেন রূপসী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক এ ব্যাপারে দাবি করেছেন যে, ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী তাদের পর্যাপ্ত জামানত রয়েছে এবং মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়নি। তার বক্তব্য অনুসারে, মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রূপসী গ্রুপের কোনো যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
রূপসী গ্রুপকে বিভিন্নভাবে সুবিধা দেওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংকের উপর তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানি না হলেও তাদের প্যাকিং ক্রেডিট সুবিধা দেওয়া হয়। ফোর্স লোন পুনঃতফসিল করা হয় এবং আমদানি এলসি’র অর্থ পরিশোধ না করায় নতুন করে ঋণ বৃদ্ধি পায়। এসব অনিয়মে ব্যাংকের শাখার অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে উঠে আসে।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে নির্দেশনা দেয় যে, রূপসী গ্রুপের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে সোনালী ব্যাংক কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় এক চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও, আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।
রূপসী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেনের দাবি, তাদের ব্যবসা টিকে থাকার জন্য সোনালী ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তবে ব্যাংকের সহযোগিতা না পাওয়ায় তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। মোশাররফ হোসেন আরও বলেন-
ব্যবসা চালু রাখার জন্য একাধিকবার ব্যাংকের কাছে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হলেও তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে তারা বাধ্য হয়ে নারায়ণগঞ্জ আদালতে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করেছে।
সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জয় কুমার রায় জানান-
খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের নিয়মিত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে কত টাকার বিপরীতে মামলা করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধান কার্যালয়ের এক জেনারেল ম্যানেজার মন্তব্য করেছেন-
রূপসী গ্রুপ ঋণ পরিশোধে অজুহাত এবং ভুল তথ্য দিচ্ছে এবং তা ব্যাংকের জন্য বিভ্রান্তিকর।
রূপসী গ্রুপের ঋণ বিতরণ, পুনঃতফসিল এবং জামানত মূল্যায়নে একাধিক অনিয়মের ফলে সোনালী ব্যাংক এখন চরম বিপাকে। এটি শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংকের জন্য একটি অন্ধকার অধ্যায় নয় বরং দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি সতর্কবার্তা। ঋণ পুনঃতফসিল, সঠিক প্রভিশন এবং আইনগত ব্যবস্থার অভাবে ব্যাংকগুলোতে এমন অনিয়ম চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু কার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।