বছরের শুরু থেকে চালের বাজার চড়া। কোন ভাবেই কমছে না চালের দাম। পর্যাপ্ত উৎপাদন, শুল্ক কমে, আমদানির ক্ষেত্রেও দরজা খোলা। বাজার তদারকিতেও বিভিন্ন কার্যক্রম। এসবেও চালের বাজারে অস্বস্তিরতা বেড়েই চলছে। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এর পর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৪ টাকায়। এ ছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫২-৫৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে। মাস তিনেক আগে মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
সরকারি সংস্থা টিসিবির বিশ্লেষণে জানা যায়, গেল এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের ৮ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও বেশি। এ সময় সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ।
সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিল বা বাজারে চালের কমতি নেই। সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন। প্রয়োজনে জড়িতদের ব্যাপারে আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। এতে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বন্যায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মিলারার বন্যার উছিলা আর মজুত ফুরিয়ে আসছে বলে ধুয়া তুলে ভোক্তার পকেট কাটছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের শুরু থেকেই এবার চালের বাজার ছিল চড়া। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এর পর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৪ টাকায়। এ ছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫২-৫৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে। মাস তিনেক আগে মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গেল এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের ৮ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও বেশি। এ সময় সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ।
চালের দামের এমন দূর অবস্থা শুধু ঢাকায় নয়, উৎপাদন অঞ্চলেও বাড়ছে দর। গেল এক সপ্তাহে নওগাঁর বাজারে বস্তায় (৫০ কেজি) ২৫০-৩০০ টাকা বেড়েছে। ফলে গত বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাটারিভোগ ৭০-৭১ টাকা, জিরাশাইল ৬৭-৬৮, সুভলতা ৬০-৬২, পারিজা ৫৮-৬০, ব্রি আর-২৮ ও ২৯ চাল ৬০-৬২ এবং স্বর্ণা জাতের চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। দামের ক্ষেত্রে প্রায় একই চিত্র রয়েছে বগুড়া, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়ায়।
একই বাজারের এক বড় পাইকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তারা এখন চালের বাজার নিয়ে খেলছেন। মিল থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত এই চক্র জাল বিছিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদারকি করলে সহজে তা বের করা সম্ভব।”
বগুড়ার শেরপুরের বিভিন্ন ধান-চাল ব্যবসায়ীরা জানান, এসিআই, রূপচাঁদা, আকিজ, পুষ্টিসহ বেশ কিছু কোম্পানি চালের দামে ফায়দা লুটছে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান-চাল কিনে গুদামজাত করে। পরে সুবিধামতো সময়ে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের প্যাকেটে মোড়কজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে। নওগাঁর ব্যবসায়ীরাও বলছেন, “তাদের চাল দিয়ে দেশের একটি বড় অংশের চাহিদা মেটে। সেখানে নিজ এলাকাতেই প্রতিদিন চালের দাম বাড়ছে। এর পেছনে যে সিন্ডিকেট জড়িত, তা সহজে বোঝা যাচ্ছে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নওগাঁর এক চাল ব্যবসায়ী জানান, “সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল মজুত করেছে। নওগাঁর কয়েকজন মিলারের কাছেই প্রায় দুই লাখ টন চাল মজুত আছে। এসব চাল তারা আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বেশি দামে বাজারে ছাড়তে পারে।”
মজুতদারিতে অভিযুক্ত বেশির ভাগ মিল মালিকরা কথা বলতে না চাইলেও নওগাঁর ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “মিলে পুরোনো কোনো ধান-চাল মজুত নেই। মোকামে কেনাবেচা না থাকায় ব্যবসা মন্দা চলছে। অবৈধ মজুতের অভিযোগ সত্য নয়।”
শুল্কছাড়েও আমদানি কম
চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। আমদানিতে মোট করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দুই দফা কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম কর রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আমদানিতে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ককর প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিতে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা। শুল্ক প্রত্যাহার হলেও চক্রটি মজুত চাল বেশি দামে বিক্রির জন্য আমদানি করছে না। বন্যার ছুতায় আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে অন্যদেরও। তাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ টন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৩৪ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ১৬৮ টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ৪৮ টন চাল আমদানি হয়।
খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “চালের যে সংকট নেই, তা পুরোপুরি সত্য। কারণ, আমি নিজে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেছি, প্রতিটি আড়ত চালে ভরা। অন্য জেলাগুলোতেও নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো যুক্তি দেখছি না। তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করব। সিন্ডিকেটকে ছাড় দেওয়া হবে না। অন্য তদারকি সংস্থাগুলোর প্রতিও অনুরোধ, তারা যেন চালের বাজারে নজরদারি বাড়ায়।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে সরকারের নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সাধারণত ১১ লাখ টন চাল রাখার কথা বলা হয়ে থাকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য বাজেট ২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ৭ লাখ ৫০ হাজার টনের জন্য আরও ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে।
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরেও দাম কেন বাড়ছে এই জবাব কারো কাছেই নেই। ধান-চাল মালিক সমিতির নেতারা মনে করেন, উৎপাদন ও চাহিদার হিসাবে গড়মিল হতে পারে। তারা আরও বলেন, খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে সরকারি তদারকি আরো বাড়াতে হবে।