দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তারা অর্থনীতি, সামরিক, কূটনীতি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বে আধিপত্য বজায় রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, যেমন চীনের উদ্ভব, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় নতুন মিত্রদের গড়ে ওঠা-এইসব ঘটনাগুলো আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে এবং অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব হয়তো তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারাতে শুরু করেছে। চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য উদীয়মান শক্তিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে।
প্রভাব বিস্তারকারী পশ্চিমা জোট ও বর্তমান কালের নতুন মেরুকরণ-
আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর আধিপত্যের ইতিহাস মূলত ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং পরবর্তীতে আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক প্রভাবের শীর্ষে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলো বিশ্ব রাজনীতির প্রাথমিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ন্যাটো, জাতিসংঘ, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তা কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা একক সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা প্রচার করে।
তবে আজকের পৃথিবীতে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রে বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একসময় যেখানে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো ছিল সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি, এখন সেখানে চীনের উত্থান এই চিত্র বদলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মতে, চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রথম স্থানে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের ওপর প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ আসে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের মাধ্যমে। একসময়ের ‘গ্লোবাল সাউথ’ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোও আজকের দিনে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যান্য দেশগুলোও নিজেদের অবস্থান স্বকীয়ভাবে তৈরি করতে সচেতনভাবে কাজ করছে ।উদীয়মান বাজার অর্থনীতি যেমন: ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব তৈরি করতে শুরু করেছে। এছাড়াও, চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বহু দেশে অর্থনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে, যা সরাসরি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে।
সামরিক দিক থেকে বিবেচনা করলে আমেরিকা এখনও সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক সেনাবাহিনী ও প্রযুক্তির মালিক। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি আমেরিকার সামরিক আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ এবং সিরিয়ায় তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে যে, তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে ও সক্ষম। একইভাবে, চীনের সামরিক সম্প্রসারণ (বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে) এবং তাদের উন্নত প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা আমেরিকার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোও ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি করছে, যেমন ইউরোপীয় দেশগুলো আমেরিকার ওপর সামরিক নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে।
এমনকি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের সহযোগী দেশগুলো ধীরে ধীরে নতুন মিত্রদের দিকে ঝুঁকছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, যা আমেরিকার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ এবং রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা এই অঞ্চলগুলোতে নতুন শক্তির পুনর্গঠন করছে।
এমনকি সৌদি আরব ও ইরান চীনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে, যা আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী প্রভাবকে দুর্বল করছে। এছাড়া আফ্রিকায় রাশিয়া এবং চীনের কৌশলগত বিনিয়োগ এবং সহায়তা পশ্চিমাদের প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করছে।
আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব প্রযুক্তির অগ্রদূত ছিল। তবে চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বিশেষ করে ৫জি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তাদের উন্নতি পশ্চিমাদের আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। হুয়াওয়ে, আলিবাবা এবং টিকটকের মতো চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দ্রুত উত্থান প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তিগত শক্তি আর কেবলমাত্র পশ্চিমাদের হাতে সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে চীনা অ্যাপ বিশেষ করে টিকটক এর আধিপত্য বেশ লক্ষণীয়। এছাড়া সাইবার যুদ্ধের ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার ক্ষমতা পশ্চিমাদের নিরাপত্তার ওপর বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আবার, বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো জ্বালানি, বিশেষ করে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। ইউরোপের শক্তি সরবরাহের ওপর রাশিয়ার আধিপত্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি দুর্বলতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হওয়া ইউরোপীয় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও তাদের শক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বলা যায়, গোটা বিশ্বই এমনকি আমেরিকাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো জ্বালানি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। আমেরিকা এবং ইউরোপ যদিও এখন বিকল্প শক্তির উৎসের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তবে সহজেই এই শক্তির নির্ভরতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেলও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চীন এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। যারা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায় কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। কেননা চীন রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে তেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি অন্যান্য দেশের জন্য ঈর্ষণীয় এবং একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত। পশ্চিমা দেশগুলোর গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং মানবাধিকার প্রচারের প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা তারা সাধারণত অন্য দেশ বা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্যই তাদের এসব এজেন্ডা প্রচার করে। এমনকি খোদ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা ও বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে।
পশ্চিমা প্রভাবের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ-
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব সত্যিই কমতে শুরু করেছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চললেও এটা স্পষ্ট যে, তারা আজ চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য উদীয়মান শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে এই নতুন প্রতিযোগিতার ফলে পশ্চিমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। তবে আমেরিকা এবং ইউরোপ এখনও বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী, যা তাদের প্রভাব বজায় রাখতে সহায়ক।
পশ্চিমা দেশগুলো যদি বর্তমান পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, নতুন মিত্রতা গড়ে তুলতে পারে এবং বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে পায়, তবে তারা হয়তো তাদের প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম হবে। তবে এই মুহূর্তে বিশ্বের ক্ষমতার কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, যেখানে নতুন শক্তিগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে এবং পশ্চিমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রভাব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব আজ এক বিশাল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চীনের উত্থান, রাশিয়ার পুনরুজ্জীবন এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি শক্তিমান জোটের বলয় এবং অন্যান্য উদীয়মান শক্তিগুলোর কার্যকলাপ বৈশ্বিক ক্ষমতার মেরুকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদিও পশ্চিমাদের প্রভাব একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য কোন দিকে যাবে তা নির্ভর করবে এই প্রতিযোগিতার ফলাফলের ওপর। পশ্চিমা ও নতুন পরাশক্তি হবার সম্ভাবনাময় দেশগুলোর জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন তাদের ক্ষমতা পুনর্গঠন এবং নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন।