বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় এক অমিত সম্ভাবনার হাতছানিতে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭০-এর দশকে যখন এই খাতের যাত্রা শুরু হয়, তখনও কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে কয়েক দশকের মধ্যেই এটি বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে। সস্তা শ্রম, অনুকূল সরকারি নীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদার কারণে এই খাত অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে।
বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতে কর্মরত, যাদের বেশিরভাগই নারী। নারীর ক্ষমতায়নে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এই শিল্পের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এত সাফল্যের পরেও এ শিল্প এখন নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শ্রম অধিকার এবং কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তন নতুন ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত ঝুঁকি এবং টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করার প্রয়োজনীয়তাও সামনে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে ভবিষ্যতে এই শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাস-
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শুরুর সময়কাল ১৯৭৮ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান ‘দায়ু’র সাথে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা নুরুল কাদের খান একটি যৌথ উদ্যোগে প্রথমবারের মতো পোশাক উৎপাদন শুরু করেন। এটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রথম পদক্ষেপ।
তবে এই শিল্পের প্রকৃত বিকাশ শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কেননা এসময়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বহুজাতিক চুক্তিগুলো সহজতর করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারগুলো বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল না বললেই চলে।
সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এ খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাটজাত দ্রব্য মোট রপ্তানিতে ৫০% অবদান রেখে রপ্তানি আয়ের শীর্ষস্থান দখল করেছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে।
১৯৯৯ সালে এই শিল্প খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়ন ও বেশি লোকের। যার মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ মহিলা। বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে রপ্তানি পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১.৮১ ভাগ। এই শিল্প আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করে আছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জুলাই এপ্রিল সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রায় পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৩,৮৫৮ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৪,০৪৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
পোশাক শিল্পের বৃদ্ধির কারণসমূহ-
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অভূতপূর্ব বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকের সহজলভ্যতা এবং তাদের মজুরি তুলনামূলকভাবে কম হওয়া। ফলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব হয়। পোশাক শিল্পের দ্রুত বিকাশের একটি বড় কারণ ৭০ দশকে অন্য দেশীয় শিল্পগুলোর প্রায় বন্ধ অবস্থার মধ্যে নতুন করে পোশাক শিল্পের বিকাশের প্রবৃদ্ধি ঘটা। সেসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মাল্টিফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টের অপ্রতুলতার কারণে বেশ কিছু দেশে কোটা সীমাবদ্ধতা ছিল। ফলে বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পোশাক রপ্তানিতে নতুন দ্বার উন্মোচন করে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে কোটা সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি-
বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প প্রায় ৪,৫০০ কারখানা নিয়ে গঠিত এবং প্রায় ৪ মিলিয়ন শ্রমিক এতে নিযুক্ত, যাদের মধ্যে প্রায় ৮০% নারী। বিশ্বব্যাপী পোশাক খাতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেমন শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে সরকার এবং মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। শ্রমিকরা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছেন, যা এই শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তুলছে।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। সেই ঘটনার পর থেকে শিল্পে বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়েছে, তবে এখনও কর্মপরিবেশের মান উন্নত করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমান যুগের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে অনেক কারখানার উৎপাদন পদ্ধতি এখনও পুরনো, যা শিল্পকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে বাধাগ্রস্ত করে। এখনও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মূলত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই শিল্পের আরও উন্নয়ন ঘটাতে ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় করতে এই এককেন্দ্রীকতা থেকে দূরে আসতে হবে। এজন্য নতুন বাজার যেমন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতিতে প্রবেশ করা জরুরি যাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করা যায়। আরো একটি ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে যে বাংলাদেশ এখনো নিম্ন মূল্যের বস্ত্রই উৎপাদন করে। এজন্য উচ্চমূল্যের পণ্য যেমন প্রযুক্তিগত পোশাক, ক্রীড়া পোশাক এবং অন্যান্য বৈচিত্র্যময় পোশাক উৎপাদনে নজর দিতে হবে।
বৈশ্বিক গ্রাহকরা এখন পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্পের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সম্ভাবনা-
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে। উন্নত অবকাঠামো, সহজলভ্য শ্রমশক্তি এবং সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা এই শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। এছাড়াও উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন এবং টেকসই উৎপাদনের দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া হলে শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের বিশ্বব্যাপী উচ্চ চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্র্যান্ডের জন্য বাংলাদেশ একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। শ্রমিকদের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতার কারণে বাংলাদেশি পোশাকের দাম কম ও প্রতিযোগিতামূলক।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। যেমন স্বয়ংক্রিয় মেশিন এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। বিশ্বমানের প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত কারখানাগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা ইতিমধ্যে পরিবেশবান্ধব কারখানায় পরিণত হয়েছে এবং ‘সবুজ কারখানা’ হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক। বর্তমানে বিশ্বের সবুজ কারখানার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বর্তমানে সাধারণত নিম্ন ও মধ্যমানের পোশাক তৈরি হয়। যার কারণে তৈরি পোশাক খাতে মুনাফার মার্জিন সীমিত। গবেষণামূলকভাবে দেখা গেছে যে, যদি দেশটি উচ্চমানের পোশাক এবং প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য উৎপাদনের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়, তবে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে মূল্য সংযোজন পণ্য যেমন উচ্চমানের ফ্যাশন আইটেম, স্পোর্টসওয়্যার এবং প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করলে বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের পণ্যের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা। তবে মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি নতুন বাজারগুলিতে রপ্তানি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে। বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এ খাতের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বাংলাদেশের পোশাক খাতে আরেকটি সম্ভাবনাময় দিক হলো, বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreement-FTA) করার মাধ্যমে বাংলাদেশি পোশাকের উপর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা রপ্তানিতে আরও প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করবে।পোশাক শিল্পের পাশাপাশি টেক্সটাইলের আরও উপখাত যেমন হোম টেক্সটাইল, টেকসই ফ্যাশন এবং ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন ক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশ করা সম্ভব।
এ সম্ভাবনা গুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত আরও এগিয়ে যেতে পারে যা দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিন্তু দেশের পোশাক শিল্পের সম্ভাবনার পাশাপাশি, কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা খাতটির দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নে প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে, এ চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। রানা প্লাজা ধস ও তাজরিন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এছাড়া পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অসন্তোষ, কম মূল্যমানের পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজনের ঘাটতি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং দক্ষ জনশক্তির অভাব, দুর্বলতা এবং কাঁচামালের ঘাটতি (কারণ অন্য উৎপাদনকারী দেশগুলো নিজেরাই কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারে), প্রায় সম্পূর্ণরূপে রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল হওয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ চ্যানেলগুলোর সমাধান না হলে আমাদের পোশাক খাতের বিপুল সম্ভাবনার সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলা যায়,বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিবর্তন দেশের জাতির উদ্যম ও সাহসিকতার একটি অসাধারণ গল্প। এই খাত আজ দেশের রপ্তানির ৮০% এরও বেশি প্রতিনিধিত্ব করে শুধুমাত্র অর্থনীতির চাকা ঘোরায় না বরং কোটি কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে। সঠিক পথে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক উজ্জ্বল প্রতীক নয় বরং উন্নয়নেরও একটি চিত্র হয়ে উঠবে। তাই, সময় এসেছে আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর এবং এই শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার।