একসময় বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী এবং বিতর্কিত ব্যবসায়িক অঙ্গন ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। তবে আজকাল, ব্যাংকিং খাতের কঠোর অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রুপটির কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
এস আলম গ্রুপ, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ এক সময় ৭টি ব্যাংকের ওপর প্রভাব রেখে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের একটি শক্তিশালী অস্তিত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তবে গত কয়েক বছরে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে গ্রুপটির অবস্থান বর্তমানে একেবারে বিপর্যস্ত।
এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই গ্রুপ প্রায় দুই ডজন কোম্পানির মালিক। যার মোট সম্পদের মূল্য আনুমানিক দেড় লাখ কোটি টাকা। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অসংখ্য কারখানা রয়েছে, যা দেশীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। তবে বর্তমানে এস আলম গ্রুপের এই বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য চরম সংকটের মুখে পড়েছে।
ব্যাংকিং খাতের বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপের সঙ্গে নতুন ব্যবসায় জড়াতে আগ্রহী নয়। এছাড়া যেসব ব্যাংক গ্রুপটির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে রাজি হচ্ছেন তারা শতভাগ মার্জিন দাবি করছেন, যা গ্রুপটির জন্য বিপদজনক। ৫ আগস্টের পর সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাইফুল আলম মাসুদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান অথবা দেশত্যাগ করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে গ্রুপটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরো সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যাংকিং সীমাবদ্ধতার কারণে এস আলম গ্রুপের বেশ কয়েকটি কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এবং কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। গ্রুপটির ডেপুটি ম্যানেজার আশীষ কুমার নাথ জানিয়েছেন, তাদের ভেজিটেবল অয়েল এন্ড রিফাইন্ড সুগার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি তাদের অন্যান্য কারখানাও একই ধরনের সংকটের মুখে রয়েছে।
এস আলম গ্রুপের অন্যতম বড় গ্রাহক ইসলামী ব্যাংক, যা ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের পেপার ভিত্তিক ফার্মের মাধ্যমে ব্যাংকটির শেয়ার কিনে এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে তারা এস আলম গ্রুপের ঋণপত্র খুলতে শতভাগ মার্জিন চাচ্ছেন, যা গ্রুপটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সত্ত্বেও তাদের কারখানাগুলো চালু রাখা অত্যন্ত জরুরি। “কেননা এর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন,” তিনি উল্লেখ করেন।
সীতাকুণ্ডের আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ২০২২ সালে অধিগ্রহণের পর থেকে এটি এখনও উৎপাদনে যায়নি। অন্যান্য ফ্যাক্টরি যেমন, এস আলম স্টিল, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস এবং ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও বর্তমানে বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। এসব কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন চালাতে পারছে না।
ইতোমধ্যে এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। গ্রুপটির ব্যাগ কারখানা থেকে প্রায় ৬০ জন কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। এছাড়া, অন্যান্য কারখানাগুলো থেকেও কর্মীদের ছাঁটাই চলেছে।
এস আলম গ্রুপের নতুন ব্যাংক হিসাব খুলতে শুরু করেছে। ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রুপটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এবং গ্রুপটির অনেক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এরপর, এস আলম গ্রুপের কয়েকটি কোম্পানি নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে।
একসময় দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপগুলির একটি, এস আলম গ্রুপ এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে এবং এই সংকটের প্রভাব শুধুমাত্র ব্যবসায়িক বিশ্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং হাজার হাজার কর্মীর জীবন ও দেশীয় অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলছে।
এস আলম গ্রুপের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এককথায় বলা যায়, তাদের সাম্রাজ্যের পতন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় দুঃখজনক অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।