বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান পরিমাণ এখন অর্থনীতির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র।
সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। এর মাত্র তিন মাস আগেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই অল্প সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
একের পর এক অনিয়ম ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা দেশের ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীলতা হারাতে বাধ্য করেছে। ২০০৯ সালে বিগত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
পরবর্তী সময়গুলোতে এই সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংক থেকে বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই এখন খেলাপিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলামের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বাস্তব চিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকার নিচে নয়। কারণ এখানে ঋণ অবলোপন, আদালতের নির্দেশে স্থগিত ঋণ এবং পুনঃতফসিল করা ঋণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীরা বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার পদক্ষেপের ফলে প্রকৃত তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে।”
সরকার পরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। সাবেক সরকারের সময়ে নানা সুবিধা দিয়ে প্রভাবশালীদের কাছে বিশাল অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। অনিয়মের মাধ্যমে কৃত এই ঋণ বর্তমানে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। গত তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যেখানে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অঙ্ক ছিল ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।
বিশেষ করে, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোতে ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন স্পষ্ট হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঋণ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত বহন করছে। মেঘনা ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, “খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। ব্যাংকিং খাতে লুকোচুরি বা তথ্য গোপনের সুযোগ আর নেই। তবে খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে তা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়। এখানে বিতরণ করা ঋণের বড় অংশই প্রভাবশালীদের হাতে, যা আদায় করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন খাতে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান
– রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ: ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা (৪০.৩৫%)
– বেসরকারি ব্যাংকগুলো: ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা (১১.৮৮%)
– বিদেশি ব্যাংকগুলো: ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা (৪.৯৯%)
– বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো: ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ-
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন হবে। তারা বলছেন, “যেসব ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলো ফেরত আনা কঠিন। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত বোঝা আরও বাড়বে।”
খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়োচিত পদক্ষেপ ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এই সঙ্কট মোকাবিলা না করলে তা ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।