বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ঢাকা শহরের অন্তরালে লুকিয়ে আছে লক্ষ/কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস। জীবিকার খোঁজে শিক্ষা ও উন্নতির প্রত্যাশায় রাজধানীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ঢাকা শহরটি যেন ভাগ্যের পরিবর্তনের আশার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু এই শহরের একটি বড় সমস্যা হলো আবাসনের অভাব। একদিকে রয়েছে থাকার সংকট, অন্যদিকে উচ্চ ভাড়ার বোঝা। ঢাকাবাসী প্রতিদিন উচ্চ ভাড়ার যন্ত্রণায় নিপতিত হচ্ছে। প্রতি বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর আতঙ্কে তারা যেন অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশের শহরাঞ্চলে বাড়তি বাসা ভাড়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য এক গভীর সংকটের রূপ নিয়েছে। একদিকে বাড়ি ভাড়া যে হারে বাড়ছে, সেই হারে বেতন বাড়ছে না। অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে বাজার খরচও কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় বেড়েই চলেছে। মানুষ প্রতিনিয়তই তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য সংগ্রাম করছে, কিন্তু পণ্যের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, এখন আর কেনাকাটায় কাটছাঁট করারও সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে, নতুন করে বাসাভাড়া বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর আরও বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বা বিবিএস (Bangladesh Bureau of Statistics) তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি হয়েছিল ২০%- ২৫%। ২০১৯ – ২০২৩ পর্যন্ত পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, রামপুরা, মহাখালী, বনানী ও মিরপুরের মত এলাকাগুলোর ভাড়া একটানা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেখানে ২-৩ রুমের বাসার ভাড়া প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। যা অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে । এতে করে তাদের ব্যবস্থানের নিরাপত্তা এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ অনেক বেড়ে যায়।
এই পরিসংখ্যান আমাদের দেখাচ্ছে, ভাড়ার বাজারে যে চাপ বাড়ছে, তা ভোক্তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। শহরে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ বাড়তি ভাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। একদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাকরি এবং উন্নত জীবনধারণের আশায় মানুষ ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে আসছে। অপরদিকে, নগর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন নির্মাণের প্রক্রিয়া এখনও পর্যাপ্ত গতিতে এগোচ্ছে না। ফলে বাড়ির মালিকরা চাহিদার সুযোগ নিয়ে ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আর কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বাড়ি হলেতো কোন কথাই নেই ; বাড়ি ভাড়া দ্বিগুন দিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- মেরুল বাড্ডায় ব্রাক ইউনিভার্সিটি স্থায়ীভাবে স্থানান্তরের পর ওখানকার আশেপাশের বাসা ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ভাড়াটিয়া আর বাড়িওয়ালার সম্পর্ক আজকাল যেন কেবল অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার খাতায় সীমাবদ্ধ। বাড়িওয়ালাদের দাবি প্রতি বছরই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব কিছুর খরচ বাড়ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই খরচের পুরোটা বা তার চেয়েও বেশি অংশ চাপানো হয় ভাড়াটিয়াদের ঘাড়ে। ভাড়াটিয়ারা মূলতঃ নিজের বাসস্থানের জন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকেন, যা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ । তবুও খরচের চাপ কেবল ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এই প্রশ্ন থেকেই যায়- কেন এই বাড়তি ভাড়ার বোঝা কেবল ভাড়াটিয়াদের ঘাড়েই পড়ে?
এটি শুধু রাজধানী বা বড় শহরগুলোর সমস্যা নয়; জেলা শহর থেকে শুরু করে গ্রামের বিভিন্ন এলাকায়ও বাড়ি ভাড়ার এই সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে আবাসিক ভাড়া বৃদ্ধির হার অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমনকি নিম্নবিত্তদের শেষ আশ্রয়স্থল বস্তিগুলোতেও স্বস্তি নেই; সেখানে ভাড়ার চাপে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর জীবনযাপন অনিশ্চয়তায় ভরে ওঠছে।
ঢাকা যেন আজ আধুনিক যাযাবরের শহরে পরিণত হয়েছে। এক সময় আরবের মরুভূমির যাযাবরদের জীবনে যেমন স্থিরতা ছিল না, তেমনি ভাড়াটিয়াদের জীবনও যেন এক অস্থির ভ্রমণের মতো। নির্দিষ্ট বাসভূমি নেই, স্থায়ী ঠিকানার নিশ্চয়তা নেই; জীবনের প্রতিটি বছর ও প্রতিটি মাস কেটে যায় নতুন ভাড়া বাড়ির সন্ধানে। প্রতিবারের স্থানান্তর মানে আসবাবপত্র পরিবহনে বাড়তি খরচ, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর সংগ্রাম এবং নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার চাপ।
বিশ্বব্যাপী শহরের অনেক মানুষই তাদের বাসস্থানের জন্য ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। ঢাকাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে ভাড়াটিয়াদের জীবন ক্রমশঃ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। নতুন বসতি গড়তে গিয়ে কেউ হয়তো মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুরে পাড়ি জমায়, কেউবা আবার বসুন্ধরা থেকে উত্তরা, এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায়। এই জীবনযাত্রায় স্থায়ী ঠিকানার অভাবে তারা হয়ে পড়ছে আধুনিক যাযাবরের মতোই।
এ ছাড়া দেশে চলমান মুদ্রাস্ফীতি এবং খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক পন্যের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয়কে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবারের বাজেটের উপর চাপ পড়ে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP- World Food Programme) ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকায় কম আয়কারীদের ৫০% এরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। ভাড়ার চাপ এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদার চাপের কারণে তারা মাঝে মাঝে একবেলা খাওয়া অথবা সস্তা এবং পুষ্টিহীন খাবারে জীবন চালাতে বাধ্য হন। ২০২৩- ২৪ অর্থ বৎসরে ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ৩০%-৪০% পুষ্টিহীন খাদ্য গ্রহণ করেছেন। যা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
তাছাড়া প্রতিনিয়ত ভাড়া বাড়তে থাকার কারণে ভাড়াটিয়াদের মানসিক চাপও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় দীর্ঘমেয়াদে থাকার সুবিধা পাওয়া তো দূরের কথা, প্রায়ই বাড়িওয়ালার খরচের চাপ এবং অতিরিক্ত চাহিদার কারণে নতুন বাড়ির খোঁজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে- শিশুদের পড়াশোনা ও সামাজিক জীবন সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। পরিবারের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের স্থিরতা যে একটা মানুষের জীবনে কতটা প্রয়োজন, তা প্রতিটি স্থানান্তরের মুহূর্তে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি সঠিক নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা:
এই সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে সুষ্ঠু ভাড়া নীতিমালা তৈরি করা দরকার। সরকারি পর্যায়ে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়া গেলে ভাড়াটিয়াদের এই দুর্দশা কমানো সম্ভব হবে। ভাড়া বাসার জন্য এলাকাভিত্তিক একটি নির্দিষ্ট মূল্যসীমা এবং বাড়িওয়ালার জন্য নির্ধারিত শর্তাবলির আওতায় একটি সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা গেলে, ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের জীবন যাত্রার মান অনেকটাই সহজ হতে পারে।
বর্তমানে শহুরে জীবনযাত্রায় বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সঠিক নিয়ম-নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অভাবে এই সম্পর্কটি তিক্ত হয়ে ওঠে। বাড়িওয়ালাদের কেউ কেউ ভাড়াটিয়াদের প্রতি জবরদস্তি করে কিংবা তাদের অধিকার হরণ করেন, আবার কোনো ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের কারণেও বাড়িওয়ালারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে নিজেদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যার ফলে অন্যের ক্ষতি কিংবা অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিষয়টি সহজেই উপেক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে এই সমস্যার সমাধানে সুনির্দিষ্ট আইন বা নিয়ম কার্যকর করার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি। সঠিক নিয়ম-নীতি এবং তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্পষ্ট আইনের অভাব লক্ষ্য করা যায়, ফলে এই খাতে নির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি করলে উভয় পক্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়া সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়ি ভাড়া ও মালিক-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক নিয়ে উন্নত দেশগুলোতে যেমন নিয়মিত আইন রয়েছে, তেমনি আমাদের দেশেও বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিটি ফ্ল্যাটের পানির খরচ যেন যথাযথভাবে নির্ধারিত হয়, সে জন্য প্রতিটি ফ্ল্যাটে আলাদা পানির মিটার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভাড়াটিয়ারা যার যার ব্যবহারের ভিত্তিতে বিল পরিশোধ করতে পারবেন, যা ন্যায্যতার পাশাপাশি সাশ্রয়েরও সুযোগ তৈরি করবে। বর্তমান ব্যবস্থায় ওয়াসা থেকে ইউনিট অনুযায়ী আলাদা মিটার সংযোগ দেওয়া হয় না, ফলে- মাসিক পানির বিলকে গড় হিসাব করে সব ভাড়াটিয়ার মাঝে ভাগ করে দিতে হয়। এই পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করে, কেননা ভিন্ন, ভিন্ন পরিবারের পানির ব্যবহার এক সমান নাও হতে পারে। আলাদা মিটার স্থাপন করা গেলে বা সাব মিটার স্থাপন করা হলে প্রতিটি পরিবারের ব্যবহার অনুযায়ী বিল নির্ধারণ করা সম্ভব হবে, যা বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক হবে। এ ছাড়া আবাসন খাতের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে সস্তা আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা গেলে, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। বাজেট ফ্রেন্ডলি আবাসনের বিকল্প তৈরি হলে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত। স্থানীয় সরকারগুলো যদি জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজনগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয় এবং তা অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করে, তবে তারা অধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে। নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের জীবনের মান উন্নত করার পথে এগিয়ে যেতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাড়তি ভাড়া ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপের সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সরকারের নীতি, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ এবং জনগণের সচেতনতা মিলিত হলে আমরা একটি উন্নত পরিবেশের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।ভবিষ্যতে ঢাকা যেন শুধুমাত্র এক আধুনিক যাযাবরের শহরে সীমাবদ্ধ না থাকে বরং একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যেই উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এই সমস্যাগুলোর সমাধান হলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং তারা সামাজিক নিরাপত্তা এবং শান্তি অনুভব করতে পারবে। তাই, আমরা একযোগে কাজ করে এই সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে পারি।