অর্থনৈতিক বৈষম্য বলতে মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্ট বৈষম্যকে বোঝায়। চাকরির সুযোগ, মজুরি কাঠামো, পণ্যের মূল্য ও প্রাপ্যতা এবং ব্যবসায় বিনিয়োগের সুযোগ- এসবই এই বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি সম্পদের বৈষম্যও বেড়ে চলছে। যেখানে কিছু মানুষ অঢেল সম্পদে ভাসছে, সেখানে অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটছে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে। এই বৈষম্য শুধু আর্থিক ক্ষেত্রে নয়- পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে সমস্যার সম্মুখীন করেছে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল স্বাধীনতার জন্যই নয়, ছিল একটি অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বাঙালি জাতি বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙে সমতা ও মর্যাদার সমাজ প্রতিষ্ঠায় জীবনপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিলেন কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ। যারা আশা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে সকলের জন্য অর্থনৈতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু চার দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও স্বাধীনতার সেই স্বপ্ন আজও অপূর্ণই রয়ে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরেও সমাজে ধনী-গরিব বৈষম্য কমেনি, বরং দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। ধনীরা আরও সম্পদে সমৃদ্ধ হচ্ছে, আর গরিবের অবস্থার অবনতি অব্যাহত। দেশে কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে স্থবির হয়ে পড়ছে।
সম্পদের বৈষম্যের বাস্তব চিত্র:
বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে ধনীদের সংখ্যা বাড়ছে, তবে তা কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে সম্পদের বৈষম্য আজ এমন একটি অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে, যা সামগ্রিক উন্নয়ন ও সামাজিক ভারসাম্যের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের শীর্ষ ১% ধনীদের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ২৪.৬%। এই অল্প সংখ্যক ধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া বৈষম্যের মাত্রাকে আরও গভীর করেছে।
তবে, এই বৈষম্যের চিত্র এখানেই শেষ নয়। দেশের সবচেয়ে ধনী ১০% মানুষের দখলে রয়েছে মোট আয়ের ৪১% এবং শীর্ষ ৫% মানুষের হাতে রয়েছে প্রায় ৩০% আয়। এর বিপরীতে দেশের সবচেয়ে নিম্ন আয়ের ১০% মানুষের হাতে আছে মাত্র ১.৩১% আয়। এই তথ্যগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, আয়ের ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানীয় ধনীরা তুলনামূলকভাবে বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে। যা বৃহৎ অংশের জনগণকে ন্যায্য আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে, যেখানে মুষ্টিমেয় মানুষের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক সুরক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক অবস্থাকেই নয় বরং সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্যকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সম্পদের এই বৈষম্য দূর করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন সুষমভাবে ছড়িয়ে পড়বে না বরং আরও সংকুচিত হবে।
অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বিশ্বে ধনী ও দরিদ্রের সম্পদের ফারাক এক অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। কর ব্যবস্থার দুর্বলতা, কর ফাঁকি, বেতন বৈষম্য এবং সম্পদের অসম বণ্টন—এসব কারণেই বৈশ্বিকভাবে ধনী-গরিবের এই বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। শীর্ষ অর্থনৈতিক জোট “জি সেভেন” ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট “জি- টোয়েন্টি” কোটিপতিদের ওপর কর বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে এই পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বিশ্বে প্রায় ৬ কোটি মানুষের সম্পদ এক লাখ ডলারের বেশি এবং ২০২৮ সালের মধ্যে এই ধনী শ্রেণির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরও বেশি বৈষম্যের জন্ম দিবে। আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থায় সংস্কারের অভাব, কর ফাঁকির সুযোগ এবং সম্পদে প্রবল অসম বণ্টনের কারণে বৈষম্য এখন অবিশ্বাস্য মাত্রায় পৌঁছেছে। মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তিদের আয়ের বিশাল অংশে কর আরোপ না হওয়ায় এবং আয় বৈষম্যের ব্যবধান ক্রমেই বাড়তে থাকায় গরিব মানুষের জীবন মান উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২০ সালের সম্মেলন- যা সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়; বিশ্বের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং করপোরেট ব্যক্তিত্বদের একত্রিত করে। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রকাশিত অক্সফামের প্রতিবেদনে বৈষম্যের চিত্রটি আরও তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, বিশ্বে ৪৬০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণের চেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে মাত্র ২ হাজার ১৫৩ জন ধনকুবেরের হাতে। এ তথ্য শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়ই নয়, বরং সামাজিক ভারসাম্যের অভাবকেও প্রতিফলিত করে।
সরকারী উদ্যোগ এবং তাদের সীমাবদ্ধতা:
সরকার সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খুবই অদৃশ্য এবং সীমিত। সংশ্লিষ্টদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গরিবদের জন্য যে প্রকল্পগুলো চালু করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। একদিকে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্য দিয়ে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে গরিবেরা শত চেষ্টা করেও তাদের ভাগ্যের উন্নতি করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছে।
এছাড়া ব্যাংক খাত এবং সরকারি ঋণের সুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই ধনী এবং প্রভাবশালীদের জন্য থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে, দেশের অনেক বড় ব্যবসায়ী যার সম্পত্তি অনেকগুণ বেড়েছে- তারা সরকারের নিকট থেকে ভর্তুকি, ট্যাক্স ছাড় বা বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। যা গরিবদের জন্য একেবারেই অসম্ভব। ফলে, দেশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ, বিশেষতঃ শ্রমজীবী মানুষ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সমাধানের পথ:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রথমতঃ সরকারের উচিত সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। করের নীতি এমনভাবে উন্নয়ন করা উচিত, যাতে ধনী শ্রেণীর উপর অধিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং মধ্যবিত্ত বা গরিবরা তার সুফল পায়। সরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে আরো সুষ্ঠু মনিটরিং প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যাতে এগুলো সঠিকভাবে গরিবদের কাছে পৌঁছাতে পারে।
অন্যদিকে, গরিবদের জন্য নতুন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। পেশাদার প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা তৈরি করার দিকে নজর দিতে হবে, যাতে গরিবরা তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে পারে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও বড় পরিবর্তন আনা একান্ত জরুরি। এই দুটি ক্ষেত্রের উন্নতি হলে সাধারণ মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে মানুষ নিজের উন্নতির পথ খুঁজে নিতে পারবে এবং দেশের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে। একইভাবে, সহজলভ্য ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে এবং কাজের ক্ষমতা বাড়াবে। তাই সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, যেন এগুলো দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে সহজে পৌঁছায়।এর মাধ্যমে গরিবদের জন্য স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং সামাজিক বৈষম্য দূর হওয়ার পথে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, ধনী শ্রেণির আয় ও সুযোগ ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যদিকে, গরিব মানুষের জীবনে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া তেমনভাবে পৌঁছাচ্ছে না। সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও, তা বাস্তবায়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো একটি বড় বাধা। এর ফলে, গরিবদের জীবনমান উন্নয়নের পরিবর্তে আরও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারি উদ্যোগগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে, ধনীদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান না করে, সেসব সুবিধা যেন সাধারণ জনগণের কাছেও পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা উচিত। গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কার্যকর বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। কেবলমাত্র বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা গেলেই বাংলাদেশ সত্যিকারের উন্নয়ন এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে পারবে।
বাংলাদেশে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, বরং সেই উন্নতির সুফল যদি সবার কাছে পৌঁছাতে না পারে, তবে সেই উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে সফল হবে না। গরিবের দেশে ধনী – গরিবের ধন হিসেবে পরিণত হতে পারে, যদি সরকারের নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়। তখনই আমরা দেখতে পাব, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হবে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য এবং সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে দেশের ভবিষ্যতের জন্য।