আজকের সমাজে বিশেষ করে আমাদের দেশ বাংলাদেশে, প্রবীণ নারীরা নানা ধরনের সমস্যার শিকার হচ্ছেন। প্রবীণ নারীদের জীবন অনেকটা নীরব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাটছে। বয়সের ভার এবং সামাজিক অবস্থার কারণে তারা প্রায়শই একাকীত্বে ভোগেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে- একাকীত্ব কেবল তাদের মানসিক অবস্থাকেই দুর্বল করে না বরং শারীরিক ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। ভয়ানক এক পরিসংখ্যান হলো- যে সমস্ত বয়স্ক নির্যাতনের শিকার হন, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি সাধারণ প্রবীণদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। অথচ এই সংকটকে প্রতিহত করতে আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখনো তেমন কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত আজকে যারা প্রবীণ; তারাও একসময় নবীন বা যুবক- যুবতী ছিল। তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ একসময় আমাদের জীবনেও বয়ে নিয়ে আসতে পারে। কারণ তরুণ প্রজন্ম প্রবীণদের প্রতি ভালো আচরণ করলে এবং সহমর্মিতা প্রকাশ করলে- ভালোটাই শিখবে। আর অবহেলা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে এর ফল ধারাবাহিকভাবে আমাদেরও ভোগ করতে হতে পারে।জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ এই সংকট দূর করতে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে। এই নীতিমালায় প্রবীণদের প্রতি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। গণমাধ্যমকে প্রবীণদের নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবীণ সংক্রান্ত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই উদ্যোগগুলো কতটুকু কার্যকর হচ্ছে বা হয়েছে ? গণমাধ্যমে প্রবীণদের নিয়ে সচেতনতার গল্প খুবই কম শোনা যায়। প্রতিটি পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। একই সাথে আমাদের প্রয়োজন এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রবীণ নারীরা শুধু সম্মানিত নন বরং নিরাপদে এবং সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ অনুভব করবেন।
বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক- ২০২৩ সমীক্ষা অনুযায়ী- দেশে বর্তমানে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৬৪ লাখেরও বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.৭ শতাংশ। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, চিকিৎসা খাতে অগ্রগতি এবং সচেতনতার ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, যা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী- ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখে পৌঁছাবে। আর ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি হতে পারে। ইউনিসেফের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিণত হবে। এই পরিবর্তন আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
প্রবীণ নারী ও একাকীত্ব: সমাজের অবহেলা-
বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রবীণদের নিয়ে গঠিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী- ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের আমরা প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করি। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান তথ্য বলছে বিশ্বে- ২০২১ সালে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৬১ মিলিয়ন। যা ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৬ বিলিয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই প্রবীনদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি।
.প্রবীণ নারীদের জীবন নানা দুরবস্থার ছায়ায় ঢাকা। অথচ দেশের অগ্রগতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও সভ্যতার প্রতিটি ধাপে তাদের রয়েছে অনন্য অবদান। পরিবারের জন্য একসময় নিবেদিত এই নারীরা আজ নিজ সন্তানদের অবহেলার শিকার। আমরা ভুলেই যাই যে, পিতা-মাতার কারণেই আমাদের এই পৃথিবীতে আসা সম্ভব হয়েছে। মা জননী প্রায় ১০ মাস আমাদের পেটে ধারণ করেছেন। অকল্পনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। মানুষের মত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের দুর্বলতা, অসুস্থতা আর একাকীত্বকে প্রায়শই উপহাস করা হয়। যা তাদের মনকে বিষণ্ণ ও বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু কতজনই বা বুঝতে চান এই প্রবীণ নারীদের অসহায়ত্বের গভীরতা ? তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্নের অভাব এবং অমানবিক আচরণ আজ আমাদের সমাজের বড় এক দৃষ্টিকটূ বাস্তবতা। তবে এর ব্যতিক্রম ও পরিলক্ষিত হয়।
.বয়স্ক নারীদের জীবনে একাকিত্ব, স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা এবং আবেগজনিত সংকট আজ ক্রমবর্ধমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. মাহবুবা সুলতানা মনে করেন- প্রবীণ নারীদের প্রধান সমস্যাগুলি স্বাস্থ্য ও আবেগকে ঘিরে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন প্রবীণদের পরনির্ভরশীল করে তোলে এবং তাদের আবেগপ্রবণতা শিশুদের মতো বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সমাজের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সত্ত্বেও নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে যৌথ পরিবারের অবসান ঘটছে। এর ফলে প্রবীণদের বিশেষ করে নারীদের দেখাশোনা ও সেবার দায়িত্ব আজ সন্তানদের পক্ষে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে পারিবারিক সহায়তার অভাব, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান নগরজীবনের একাকিত্ব প্রবীণ নারীদের জীবনে নিরাপত্তাহীনতার ছায়া ফেলছে।
.দেশে প্রচলিত উত্তরাধিকার আইন ও ভূমি বণ্টনব্যবস্থার কারণে নারীরা প্রায়শই তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। মেয়ে, স্ত্রী, মা, বোন কিংবা দৌহিত্রীর তুলনায়- পুরুষদের- ছেলে, স্বামী, বাবা, ভাই বা দৌহিত্রীর- সম্পত্তির অধিকার অনেক বেশি। আমাদের আইন অনুযায়ী- নারীরা সাধারণত পুরুষদের তিন ভাগের এক ভাগ সম্পত্তির অধিকারী হন, যা তাদের বৈষয়িক অবস্থানকে দুর্বল করে তোলে।
এ পরিস্থিতি প্রবীণ নারীদের ক্ষেত্রে আরও প্রকট। দেশে প্রায় ৭৮% প্রবীণ নারী বিধবা, যা তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক অবস্থানকে কঠিন করে তুলেছে।এসব নারীর জন্য শারীরিক ও আবেগিক সহায়তার পাশাপাশি, তাদের উত্তরাধিকার অধিকার সুরক্ষিত করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমান আইন ও প্রথা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে, যা তাদের জীবনের মান উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সমাজের দায়বদ্ধতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
বাংলাদেশে বয়স্ক ও বিধবা নারীদের জন্য ভাতা কর্মসূচি চালু রয়েছে, যা দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে ৫৮.০১ লাখ বয়স্ক ব্যক্তি এই ভাতার আওতায় মাসিক ৬০০ টাকা করে পাচ্ছেন এবং প্রায় ২৫.৫৭ লাখ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী এই বিশেষ সহায়তা পাচ্ছেন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক এই কর্মসূচি চালু হয়, যা দরিদ্র ও অসহায় প্রবীণ এবং বিধবা নারীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবীণ ও বিধবা নারীদের জন্য এই ভাতা প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বেড়েছে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ভাতার পরিমাণ ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এসব অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুটা হলেও আর্থিক সহায়তা এনে দেবে। বাংলাদেশে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সমাজে আরও বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো ও যোগ্যতার মাপকাঠি শিথিল করা সময়ের দাবি।
তাছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের সমাজে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি দরকার। প্রবীণ নারীদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি, পরিবার এবং সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে প্রবীণ নারীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
পরিবারগুলোকে আরও সচেতন করতে হবে। অনেক পরিবারে আজও প্রবীণদের অবহেলা করা হয়। অথচ, তাদের প্রতি সম্মান ও সেবা প্রদান আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুশিক্ষা ও পরিবারে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্ব শেখানো প্রয়োজন।
প্রবীণ নারীরা আমাদের সমাজের অমূল্য রত্ন। যাদের জীবনজুড়ে রয়েছে নানা শিক্ষণীয় ঘটনা, সংগ্রাম এবং অভিজ্ঞতা। তবে যদি তাদের সঠিক যত্ন ও সহায়তা না দেওয়া হয়, তবে সমাজের এই শ্রেণীটি এক ধরনের অপ্রতুলতা ও অবহেলার শিকার হবে। আমাদের এই সমাজে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা দরকার, যেখানে প্রবীণ নারীরা সম্মান এবং সহযোগিতা পাবেন। তারা যদি তাদের জীবনের শেষ সময়টুকু সম্মানজনকভাবে কাটাতে পারেন, তবে তা আমাদের সবার জন্য সম্মানের ব্যাপার হবে।
আমাদের দায়িত্ব, এই অবহেলিত মুখগুলোকে সহানুভূতি এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সামাজিক সমর্থন এবং সরকারের সহায়তার মাধ্যমে প্রবীণ নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুখী জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।