চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সম্পত্তি মর্টগেজ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে রিসিভার নিয়োগ, ক্রোকাদেশ, বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা, পাসপোর্ট জব্দ, একাধিকবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ফলে খেলাপি ঋণ আদায়ের হার বেড়েছে।
এরই মধ্যে বিগত চার বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বন্ধকি সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যাংকের অনুকূলে মালিকানা স্বত্ব পেয়েছে।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ আদালতের ইতিহাসে প্রথম রিসিভার নিয়োগের আদেশ দেয়া হয় ২০২২ সালে। ‘হিলভিউ এন্টারপ্রাইজ’ নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিটি ব্যাংকের মামলায় প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি সম্পত্তি ‘ফোরাম সেন্ট্রাল বিল্ডিং’ নামের বাণিজ্যিক ভবনে রিসিভার নিয়োগ দেয় অর্থঋণ আদালত। ওই বন্ধকি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ১৮ লাখ টাকা আয় হয়। রিসিভার নিয়োগের পর ‘হিলভিউ এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘হিলভিউ শিপ ব্রেকার্স’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের ২৩ কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণ আদায় করে ব্যাংক। এছাড়া আহম্মদ লাল মিয়া নামের এক ব্যবসায়ীর আরেকটি প্রতিষ্ঠানও সিটি ব্যাংককে ৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছে।
রিসিভার নিয়োগের আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল মহল মার্কেটের বন্ধকি সম্পত্তির বিপরীতে ৬০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিষ্পত্তি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন আহমেদ পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে ৮৬ কোটি ৭২ লাখ ২৪ হাজার ১ টাকা ৩৭ পয়সা খেলাপি হয়ে যায়। পরে ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রিসিভার নিয়োগ দিলে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে ৬০ কোটি টাকা পরিশোধের সমঝোতা হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি মোট ৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতেই পরিশোধ করে ২৭ কোটি টাকা।
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ পরিশোধের তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। মূলত খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক মামলা করলেও বিচারিক কাজে দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংকের আইন শাখায় জনবল সংকট, পরোয়ানা জারি সত্ত্বেও গ্রেফতার না হওয়ায় ঋণ আদায় ব্যাহত হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করলেও মর্টগেজ রাখা সম্পত্তির ভোগদখলসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফাও করছিল। এ কারণে সম্পত্তিগুলোতে নিরপেক্ষ রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে গ্রাহকের লাভজনক আয় ব্যাংকের দায় পরিশোধের সঙ্গে সংযুক্ত করার পর ঋণ পরিশোধে আগ্রহী হয়ে উঠেছে খেলাপি গ্রাহকরা। রিসিভার নিয়োগ ছাড়াও ক্রোকাদেশ, পরিচালকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার কারণে ঋণ আদায়ের হার বেড়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক কনজিউমার পণ্য আমদানি, মোড়কজাত ও বিপণনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসএ গ্রুপ দেড় বছরে বিভিন্ন ব্যাংকের ৪৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। চট্টগ্রামের এককালের শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার মোস্তফা গ্রুপ কয়েক বছরের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের ২৯৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেছে। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ ২০২৪ সালের শেষার্ধে সোনালী ব্যাংকের ১১৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নতুন করে ব্যবসায় ফিরে এসেছে। অর্থঋণ আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের কর্ণধার খলিলুর রহমানের জামাতা লিজেন্ড হোল্ডিং ও লিজেন্ড টেক্সটাইলের মালিক এসএম আবদুল হাই ন্যাশনাল ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের ১০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি খেলাপি গ্রাহকদের নিজ বাসভবন ক্রোকের আদেশের কারণে বেশ কয়েকটি ঋণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। বেসিক ব্যাংকের মামলায় চট্টগ্রামের ক্লিফটন গ্রুপের মালিক এমএম কামাল উদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। শিল্প গ্রুপটির কাছে বেসিক ব্যাংকের মোট পাওনা ৬৯ কোটি টাকা।
একইভাবে সম্পত্তি ক্রোকের মাধ্যমে ১৫ বছরের পুরনো মামলায় ৫৬ কোটি টাকা আদায় (অর্থঋণ মামলা নং-৪/২০১২), গ্রেফতারি পরোয়ানার পর মেসার্স সাজিদ স্টিল ও মেসার্স আয়াস স্টিলের ২২ বছরের পুরনো ৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়, ৩৯ বছরের পুরনো মামলায় সুলতানা জুট মিলের ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা ও মোনাভিটেক্সের ৪০ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংক।
চট্টগ্রাম জজ কোর্টের অর্থঋণ আদালতসংক্রান্ত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণের আধিক্য সত্ত্বেও এখানে অর্থঋণ আদালত মাত্র একটি। এরপরও নানা উদ্যোগ নেয়ার ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে খেলাপি ঋণের আদায় বেড়েছে। চট্টগ্রামে আরো দুটি অর্থঋণ আদালতের অনুমোদন হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আদালত বৃদ্ধির পাশাপাশি জনবল বাড়ানো গেলে ব্যাংকে রাখা মানুষের আমানত ফেরত পেতে আরো বেশি সুবিধা হবে।’
সোনালী ব্যাংক, চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপক (উত্তর) মুসা খান বলেন, ‘ব্যাংকের উদ্যোগের পাশাপাশি আদালতের অনমনীয় অবস্থানের কারণে খেলাপি গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে কিছুটা হলেও এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে মর্টগেজ থাকা সম্পত্তির বিপরীতে দেয়া আদেশের কারণে ও নতুন করে ব্যবসায় ফিরতে চাওয়া চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করে নিয়মিত হতে চাইছে। নতুন ঋণ প্রদানে সজাগ থাকার পাশাপাশি পুরনো ঋণ আদায়ে উদ্যোগ বাড়ানো গেলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো কমিয়ে আনা সম্ভব।’
চট্টগ্রামে তিনটি বাণিজ্যিক আদালত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের উত্থানপর্বে তিনটি বাণিজ্যিক আদালতের পরিবর্তে ২০০৩ সালে একটি অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে বড় খেলাপি ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের সবচেয়ে বৃহৎ খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলা (একক মামলা হিসেবে) থাকলেও একটিমাত্র অর্থঋণ আদালতের কারণে পুরোপুরি সেবা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। তবে সীমিত জনবল দিয়েও বিগত কয়েক বছরে একাধিক কঠোর আদেশের কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ের হার বেড়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তৎপরতায় সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামভিত্তিক খেলাপি ঋণের মামলাগুলো বেগবান হয়েছে। বিশেষ করে যেসব ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি ছিল, সেসব ঋণ আদায়ের হার বেড়েছে।’ লাভজনক প্রতিষ্ঠান সত্ত্বেও মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে দীর্ঘদিন ঋণ পরিশোধ না করলেও গ্রেফতারি পরোয়ানা, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার মতো আদেশের হার বাড়লে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
অর্থঋণ আদালত ও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ঋণ ফেরতে এগিয়ে আসছেন অনেক ব্যবসায়ী। আগের মতো প্রশাসনিক সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা বেড়েছে বলে মনে করেন তারা।