একসময় পাহাড়ি জনজীবন ছিল প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝরনার অফুরন্ত পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সেই চিত্র এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। শুকিয়ে গেছে ঝিরি-ঝরনা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষি ও জনজীবন বন্ধ হয়ে গেছে পাহাড়ি সংস্কৃতির বহু ঐতিহ্যবাহী উৎসব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পাহাড়ি এলাকায় প্রচণ্ড গরম পড়ছে এবং দ্রুত বাষ্পীভবনের কারণে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, নষ্ট হচ্ছে ফসল, এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাচীন উৎসব সংস্কৃতি।
বান্দরবানের রেইছা ইউনিয়নের রেইছা খাল একসময় পানির অন্যতম উৎস ছিল যা এখন পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, পানি না থাকায় চাষাবাদে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ‘পানি খেলা’ও এ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক এলাকায়। কেউ কেউ আবার বিকল্প উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে রীতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের তংমক পাড়া, মোয়ালপিপাড়া, ও পলিতং পাড়ার গল্পও একই। ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ায় এসব পাড়ায় চার বছর ধরে পানি খেলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, বিকল্প পানির উৎস স্থাপনে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করলেও এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের ক্যবুপাড়ায় রেমায় ফ ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে সাংগ্রাই উৎসব বাতিল করতে হয়েছে। ঝিরিটির ওপর নির্ভর করে থাকা ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর ১৪টি পাড়ায় খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একই রকম সংকটে পড়েছেন থানচি সদরের তংক্ষ্যংপাড়া ও বলিপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দারাও।
এ সংকট শুধু সংস্কৃতি কিংবা দৈনন্দিন জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, কৃষির ওপরেও পড়েছে ভয়াবহ প্রভাব। রেইছা ইউনিয়নের কৃষক লাচা ম মারমা জানান, পানির অভাবে তার ভুট্টা, ধান ও ঢেঁড়সের ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। অপর কৃষক আহমদ কবির বলেন, ২০ হাজার টাকা ঋণ করে বেগুন চাষ করেছিলেন, কিন্তু পানির সংকটে সব গাছ পুড়ে গেছে যা পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এখন তিনি ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলাতেও একই সংকট। কুকিছড়া, ত্রিপুরাপাড়া, সোহেলপাড়া, বারুদগলা প্রভৃতি এলাকায় ছড়া ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ পানির জন্য স্থানীয়দের ভরসা এখন কুয়া। কিন্তু কুয়ার পানিও স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আর তোলা যাচ্ছে না। গ্রামগুলো পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় পানির উৎস পেতে ৫০০ থেকে ৮০০ ফুট নিচে নামতে হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য অরুণ চাকমা বলেন, তীব্র গরমে পাহাড়ি মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কুকিছড়ার কিরণ জয় চাকমা জানান, নারীরা প্রতিদিন কয়েকশ ফুট নিচে নেমে অল্প পানি সংগ্রহ করছেন যা দিয়ে দুই-তিনদিন পরপর গোসল করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
এই জলসংকট শুধুমাত্র একটি মৌসুমি সমস্যা নয় বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত নীতিহীনতার ফল। পার্বত্য অঞ্চলে সেগুন গাছের একচেটিয়া চাষ ব্যাপক পানি শোষণ করে এবং অন্য কোনো গাছকে বেড়ে উঠতে দেয় না ফলে জলাধারগুলো দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উন্নয়নকর্মী পলাশ খীসা বলেন, এসব কারণে কৃষি উৎপাদন কমছে গবাদিপশুর মৃত্যুর হার বাড়ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমন চাকমা বলেন, পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। পানির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হলেও কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী রকি দে বলেন, দুর্গমতার কারণে এসব এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত সেবা পৌঁছায়নি, তবে রিং ওয়েল ও গ্র্যাভিটি ফ্লো সিস্টেম প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এমএম শাহ নেওয়াজ জানান, পানি সংকট ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সবচেয়ে তীব্র হয়, যা আমবাগান থেকে শুরু করে সবজিখেত পর্যন্ত ধ্বংস করছে। বৃষ্টির সময় দেরি হওয়ায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই সংকট কাটাতে হলে বড় পরিকল্পনার দরকার। মানুষকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে হবে। তবেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বন উজাড়ই এই সংকটের প্রধান কারণ। তাপমাত্রা বেড়ে বাষ্পীভবন বেশি হচ্ছে ফলে ঝিরি-ঝরনা দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। বড় গাছগুলো পানি সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। তাই তাদের উজাড় হওয়ায় পানি চক্রই ভেঙে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাষাবাদ ও জনজীবনকে বাঁচাতে হলে টেকসই পানি সংরক্ষণের কৌশল গ্রহণ করতে হবে। নইলে এই সংকট ক্রমশ গভীরতর হয়ে পড়বে।’