ইসলামি ব্যাংকিং খাত নিয়ে নতুন করে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ১০টি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে দুটি বড় ব্যাংক গঠনের সম্ভাবনার কথা বলেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তার এই মন্তব্যে ব্যাংক খাত নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন।
বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ ছাড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। জনপ্রিয়তা থাকলেও, সুশাসনের অভাবে কিছু ব্যাংক সংকটে পড়েছে।
বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের প্রভাবাধীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। সরকার পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় রদবদল আসে। এখন এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, শাহজালাল ইসলামী, আল-আরাফাহ্ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অবস্থা তুলনামূলক ভালো।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক এনেছে নতুন আইন—‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’। এটি কার্যকর হলে আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা কিংবা অবসায়নের পথ খুলে যাবে।
তবে প্রশ্ন উঠছে—এই একীভূতকরণ আদৌ কার্যকর হবে কি না? অনেকেই বলছেন, সব ব্যাংক একসাথে জোড়া লাগানো ঝুঁকিপূর্ণ।
একাধিক ইসলামি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলছেন, সমস্যা নির্ভর করে ব্যাংকভেদে। কেউ ভালো করছে, কেউ করছে না। তাই একযোগে ১০টি ব্যাংক জোড়া লাগানো বাস্তবসম্মত নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, “সংখ্যা কমালে লাভ হবে না, আগে দরকার সুশাসন। অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত না করে একীভূতকরণ কার্যকর হবে না।”
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিনও একই মত পোষণ করেন। তার মতে, “প্রথমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সক্ষম করে তুলতে হবে। পরে একীভূত করা যেতে পারে।”
বর্তমানে অনেক ব্যাংকই আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম দিয়ে তাদের সম্পদের মান যাচাই করছে। সেই ফলাফল দেখেই ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত আসবে।
গভর্নরের বক্তব্য ঘিরে আলোচনার ঝড়
৯ এপ্রিল, রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এ এক অনুষ্ঠানে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ছোট ছোট অনেক ইসলামি ব্যাংক সংকটে আছে। তাদের একীভূত করে দুটি শক্তিশালী ব্যাংক গড়ার পরিকল্পনা করা যেতে পারে।”
তিনি জানান, ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা আইন ও তদারকি কাঠামো আনার ভাবনাও চলছে। আন্তর্জাতিক মডেল অনুসরণ করেই এই সংস্কার হবে।
ব্যাংক খাতের পুরনো ব্যথা, নতুন চিন্তা
অনিয়ম, খেলাপি ঋণ আর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক ব্যাংকই বিপদে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়—ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার। একীভূতকরণ হতে পারে তার একটি দিক। তবে তাড়াহুড়ো নয়, দরকার সময় নিয়ে পরিকল্পনা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “একীভূতকরণ এক বিকল্প হতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুত হতে সময় দিতে হবে।”
সতর্ক বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক এখনই একীভূতকরণে হাত দিচ্ছে না। মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আমরা এখনও মার্জার শুরু করিনি। অধ্যাদেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।”
তিনি জানান, ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষা। এরপরই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইসলামি ব্যাংক খাত জনপ্রিয় হলেও সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একীভূতকরণ হতে পারে সমাধানের পথ, যদি তা হয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে। তবে তাড়াহুড়ো নয়, প্রয়োজন পরিকল্পিত ও ধাপে ধাপে এগোনো।