চলতি অর্থবছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতিতে ইতিবাচক এই পরিবর্তনের পেছনে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধিকে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে একই সঙ্গে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির হ্রাস এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগও তৈরি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, মার্চ মাসে মোট ৬.৪৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের মার্চে খোলা ৬.০৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৬.২৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতিমাসেই এলসি খোলার পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.৮৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। ফলে তারা আগের চেয়ে সহজে এলসি খোলার সক্ষমতা অর্জন করেছে। মার্চ মাসে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্তি। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে মোট ২১.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ১৭.০৭ বিলিয়নের তুলনায় ২৭.৬ শতাংশ বেশি।
একইভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে গত অর্থবছরের এই সময়ের আয় ছিল ৩৪.৬১ বিলিয়ন ডলার। এতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.৬৩ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী বলেন, “দেশে বড় আকারের ভোক্তা শ্রেণি রয়েছে, যাদের চাহিদা খুব একটা কমেনি। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি অব্যাহত রাখতে হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বৈশাখ ও দুই ঈদকে কেন্দ্র করে মৌসুমী চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমদানির চাপ বৃদ্ধি পায়। এসব পণ্যের জন্য এলসি কয়েক মাস আগেই খুলতে হয়।”
এছাড়া জুলাই-মার্চ সময়ে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৪ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৭.৪৪ বিলিয়নের তুলনায় ১৩.৪১ শতাংশ বেশি। মোহাম্মদ আলী বলেন, “রপ্তানি বাড়ায় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলাও বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় ব্যাংকগুলো এখন ফ্রি-লিমিট এলসি খোলায় সাহস দেখাচ্ছে। এ কারণে এলসি খোলায় ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।”
তবে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির এই ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও উদ্বেগ রয়েছে বিনিয়োগের গতি নিয়ে। কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ কমে গেছে ২৬ শতাংশ যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য অশনিসংকেত। একই সঙ্গে কমেছে মধ্যবর্তী পণ্য ও পেট্রোলিয়াম আমদানিও। মোহাম্মদ আলী বলেন, “মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে খুব বেশি গ্রাহক আগ্রহ দেখাচ্ছে না যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী নন।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মন্তব্য করেন, “ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ধারাবাহিক পতন বোঝায় শিল্প খাত উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এতে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে পারে।”
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর. এফ. হোসেন জানান, রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ ভালো অবস্থানে আছে। তদুপরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ওভারডিউ পেমেন্ট পরিশোধে মনোযোগী হচ্ছে বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট। ফলে এলসি নিষ্পত্তির হারও বেড়েছে।
এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “বর্তমানে ব্যাংকগুলো ডেফার্ড এলসির পরিবর্তে শিডিউল পেমেন্টের মাধ্যমে এলসি খুলছে। এতে ডেফার্ড পেমেন্টের চাপ কমেছে এবং ব্যাংকিং খাতের ওপর পেমেন্টের সামগ্রিক চাপও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান ডলার সরবরাহ পরিস্থিতি ও এলসি নিষ্পত্তির গতি বজায় থাকলে তা বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তবে বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও শিল্প খাতের সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে না পারলে এই অগ্রগতি টেকসই হবে না।