জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা কলমবিরতির কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাঁচ দিনের এ কর্মসূচির ফলে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রপ্তানিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত কর্মসূচির বাইরে রাখা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
কর্মকর্তারা তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলনে থাকলেও এর চাপ গিয়ে পড়ছে ব্যবসায়ী মহলে। ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতারা দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন। আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আজ বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এজন্য কলমবিরতির কর্মসূচি আপাতত সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। জানা গেছে, আলোচনায় দুই ক্যাডারের মোট ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, “রাজস্ব খাত দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে কলমবিরতির মতো কর্মসূচি কখনো কাম্য নয়। কাস্টমস ও আয়কর কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সরকার যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে নিতে আগ্রহী বলেই আমার বিশ্বাস।”
তিনি আরও বলেন, “অর্থনীতি সচল রাখতে রাজস্ব খাতে কর্মরতদের যেকোনো দাবি সরকার মনোযোগ দিয়ে শুনবে বলে আশা করি। দ্রুত সমাধান না হলে দেশের আর্থিক ক্ষতি বাড়বে।”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, “রপ্তানি খাত কলমবিরতির আওতামুক্ত রাখা হলেও এর পরোক্ষ প্রভাব মারাত্মক। আমদানিকৃত কাঁচামালের খালাসে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানির সময়সীমা (লিড টাইম) বেড়ে যাচ্ছে যা দেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের উচিত এই সংকট দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। না হলে রপ্তানি খাতের সুনাম ও কার্যক্রম উভয়ই ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৫ হাজার ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ দৈনিক রাজস্ব আদায়ের গড় দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে প্রবৃদ্ধি না থাকলে এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী, পাঁচ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। তবে গত বছরের তুলনায় ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরলে ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
টানা পাঁচ দিনের কলমবিরতির ফলে দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। সাধারণত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট জমা পড়ে, যার মধ্যে আমদানি সংক্রান্ত পাঁচ হাজার এবং রপ্তানি সংক্রান্ত প্রায় দুই হাজার ডকুমেন্ট থাকে। শুল্কায়ন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে এসব পণ্য বন্দরে খালাস ও জাহাজীকরণ করা হয়। কিন্তু কলমবিরতির কারণে এই কার্যক্রম অর্ধেকে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ডেলিভারিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস অ্যান্ড ক্লিয়ারিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (সিঅ্যান্ডএফ) কাস্টমস সম্পাদক এএসএম রেজাউল করিম স্বপন বলেন, “কলমবিরতির কারণে বিকেল ৩টার পর কাজ শুরু হচ্ছে, তখন হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সকালবেলা সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা ফিরে যাচ্ছেন, আবার বিকেলে অনেকে আসছেন না। কাস্টমস কমিশনার ফাইলের কাজ সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে বললেও কাজের গতি থমকে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে হঠাৎ গেজেট প্রকাশ করা একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। এতে আমদানিকারকরা শত শত কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন না হলে অর্থনীতির ওপর আরও বড় ধাক্কা আসবে।”
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, “প্রতিদিন বন্দরে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়। তবে সাম্প্রতিক কর্মবিরতির ফলে ডেলিভারির সংখ্যা নেমে এসেছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজারে। এই ডেলিভারি হচ্ছে আগেই শুল্কায়ন হওয়া কনটেইনার থেকে। এখনকার স্থবিরতার প্রকৃত প্রভাব আগামী কিছুদিন পরই প্রকট হয়ে উঠবে।”
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ সরকারের আলোচনার প্রস্তাব পাওয়ার পর সোমবার বিকেলে কলমবিরতি কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দেয়। আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। কাস্টমসের উপকমিশনার ইমাম গাজ্জালী, শাহাদাত জামিল এবং আয়কর উপকর কমিশনার সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
ইমাম গাজ্জালী বলেন, “আমাদের এই আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ট্যাগিং ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একে ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের সৃষ্টি’ বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই, এ আন্দোলন সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যৌক্তিক ও স্বতঃস্ফূর্ত দাবি-আন্দোলন। মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে এটি দমন করা যাবে না বরং আন্দোলনের শক্তি আরও বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা আহ্বান করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য আলোচনায় থাকবেন। আলোচনার অগ্রগতি অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের আশা করছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। তবে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে দেশের রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।