বিশ্ব আজ এক অস্থির সময় পার করছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সামরিক সংঘাত ও বাণিজ্যিক বিরোধের জটিলতায় বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে পড়েছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন-রাশিয়া, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ও ভারত-পাকিস্তানকে ঘিরে পুরোনো দ্বন্দ্বগুলো যেমন নতুন মাত্রা পেয়েছে তেমনি এসব সংঘাতের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী শিল্প, সেবা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ পরিবেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতিই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ যা বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এই উত্তেজনাগুলোর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পণ্যের সরবরাহে বিঘ্ন, শিল্প উৎপাদনে ভারসাম্যহীনতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে খাদ্য, জ্বালানি ও দুষ্প্রাপ্য খনিজ পর্যন্ত সবখানেই সরবরাহচক্রে ব্যাঘাত দেখা দিচ্ছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছে, ভূরাজনৈতিক বিভাজন এখন আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ, সম্পদের মূল্য এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় শুরু হওয়া শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় গভীর চাপ সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ৯০ দিনের শুল্ক বিরতি কার্যকর হয়েছে তবু এই বিবাদের কারণে অনিশ্চয়তা একটুও কমেনি। চীনকে কেন্দ্র করে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীনও খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা বাড়ছে, নগদপ্রবাহে টান পড়ছে এবং চীন বিকল্প বাজারে নজর দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে শিল্প খাতে প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান ‘ট্রিপল এ’ থেকে ‘এএ১’ এ নামিয়ে দিয়েছে ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি’স। সংস্থাটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি ও অনিশ্চিত বাণিজ্যনীতি বিশ্বজুড়ে ঋণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন রেটিংপ্রাপ্ত এবং স্পেকুলেটিভ-গ্রেড কোম্পানিগুলোর ডিফল্টের ঝুঁকি বাড়ছে যা বিনিয়োগ পরিকল্পনা স্থগিত করে এবং ভোক্তা আস্থা কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করছে।
জাতিসংঘও তাদের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হ্রাসের কথা বলেছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ শতাংশে নামতে পারে এবং ২০২৬ সালে তা দাঁড়াতে পারে ২ দশমিক ৫ শতাংশে যা পূর্বাভাসের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ কম। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) গত অক্টোবরেও পণ্য বাণিজ্যে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিলেও চলতি মাসে তা সংশোধন করে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের বাণিজ্য সংকোচনের দিকে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি হবে ঋণাত্মক দশমিক ২ শতাংশ।
এই পরিস্থিতির পেছনে দায়ী করা হচ্ছে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন সংঘাতকে। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবনতিও গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরে হামলার জেরে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে এবং তা যুদ্ধে রূপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি এলেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সংহতি ও বিদেশি বিনিয়োগে ধীরতা এসেছে।
এ অঞ্চলের দুই দেশেরই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারত যেমন টেক্সটাইল, ওষুধ, কৃষিপণ্য ও প্রযুক্তি খাতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে, পাকিস্তান তেমনি তুলা, চাল ও ওষুধ উৎপাদনে প্রতিযোগিতামূলক। এছাড়া উভয় দেশই স্থল ও সমুদ্র করিডোর ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। এই সংঘাত সরবরাহ শৃঙ্খলা ও বাণিজ্যিক সংযোগে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চতুর্থ বছরে গড়িয়েছে। কৃষি, পর্যটন, পরিবহন ও জ্বালানি খাতসহ নানা খাতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় গ্যাস সরবরাহকারী যার বাজার অংশ ছিল ৪০ শতাংশ। যুদ্ধের আগে দেশটি বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের ১৪ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ৯ শতাংশ জোগান দিত। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর সেই অবস্থান দুর্বল হয়েছে। একইভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেন একসময় বৈশ্বিক গমের ৩০, যবের ৩২ এবং সূর্যমুখী তেলের ৫০ শতাংশ সরবরাহ করত, যা যুদ্ধের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এই যুদ্ধের প্রভাব এখন শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং গাজায় চলমান যুদ্ধ সরাসরি প্রভাব ফেলছে লোহিত সাগর হয়ে চলা বিশ্ব বাণিজ্যে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজে হামলা শুরু করে। এখন অনেক জাহাজই নিরাপত্তার কারণে সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকা উপকূল হয়ে বিকল্প পথে পণ্য পরিবহন করছে যার ফলে খরচ ও সময় দুই-ই বেড়েছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি জানিয়েছেন, এর ফলে সুয়েজ খাল থেকে মাসিক আয় কমেছে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালেই দেশটির ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলারে।
সব মিলিয়ে, বর্তমান বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা সরবরাহ শৃঙ্খলা, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং ব্যবসার ব্যয়কে বাড়িয়ে তুলেছে। বিনিয়োগ আস্থায় চিড় ধরেছে সুদের হার ও মুদ্রানীতিতে এসেছে কড়াকড়ি। যদিও ব্রিকস বা চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন নতুন বাণিজ্যিক মেরুকরণের আভাস মিলছে তবুও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং এ মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি যে দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছে তা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন আরও সমন্বিত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ।