২০১৩ সালে ‘অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রবেশদ্বার’ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল পায়রা বন্দর। এক দশক পেরিয়ে এটির বর্তমান চিত্র হয়ে উঠেছে হতাশাজনক—সীমিত ব্যবহার, লাগাতার ড্রেজিং, আর্থিক অস্বচ্ছতা এবং নতুন করে অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা।সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, পায়রা বন্দরের জন্য আবারও নতুন করে ৫ হাজার ৩১২ কোটি টাকার তিনটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং এবং দুটি ড্রেজার কেনায় ব্যয় হবে ৪ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া প্রকল্প প্রস্তাবনায় দেখা যায়:
- রাবনাবাদ চ্যানেলে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং : ৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা
- দুটি হপার ড্রেজার কেনা : ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা
- ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা : ১৬১ কোটি টাকা
- কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন : ৪৯০ কোটি টাকা
এর আগেও পায়রা বন্দর উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২০১৬ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং : ৬ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা, ২০২০-২০২২ সালে ইমার্জেন্সি ড্রেজিং : ৪১৩ কোটি টাকা, ২০২০-২০২৪ মেয়াদে ড্রেজিং ও রাজস্ব কর্মসূচি : ৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা তবে এত খরচের পরও বন্দর এখনো বড় জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়নি। নিয়মিত পলি জমায় চ্যানেল আবার ভরাট হয়ে পড়ে। নিজস্ব ড্রেজার না থাকায় আবার নতুন করে কেনার উদ্যোগ নিতে হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্পে বেশ কিছু ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেমন:
- দুটি ড্রেজারের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার খরচ এবং এর প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা
- ১৭৭ জন পরামর্শকের জন্য ২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা
- বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা
- অস্পষ্ট ড্রেজিং পরিমাণ, সময়সূচি ও খরচের ব্যাখ্যা
- সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঘাটতি
পায়রা বন্দর এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। আন্তর্জাতিক শিপিং রুট নেই, কনটেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধা বা রেল–সড়ক সংযোগও অসম্পূর্ণ। বর্তমানে এটি মূলত একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সীমিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের পূর্ণ সক্ষমতা থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের আগ্রহও নেই পায়রার প্রতি।
অর্থনীতি উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্পষ্টভাবে বলেন, “পায়রা আদতে সমুদ্রবন্দর নয়, বরং ছোট নৌযানের ঘাট। প্রতিবছর ড্রেজিং না করলে এটি অচল হয়ে পড়ে। এত টাকা খরচ করে এমন একটি বন্দর টিকিয়ে রাখা দেশের অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া।” তিনি আরও বলেন, “ব্যয় বিপুল হলেও আয় নেই। ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, কিন্তু খরচ আকাশচুম্বী।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেট ঘাটতি, বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস ও ব্যয় সংকোচনের সময় এ ধরনের প্রকল্পে আবারও বিপুল অর্থ ঢালা দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন তোলে। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এত টাকা খরচ করেও যদি ব্যবহার নিশ্চিত না হয়, তাহলে তা অপচয় ছাড়া কিছু নয়। যেটুকু অবকাঠামো আছে, তা যেন অন্তত সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার হয় সে জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী পরিকল্পনা দরকার।”
পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় শর্ত দেওয়া হয়েছে— পায়রা বন্দরের গত পাঁচ বছরের আয়-ব্যয়ের পূর্ণ বিশ্লেষণ জমা দিতে হবে, নতুন ড্রেজিং ও ড্রেজার কেনা থেকে কীভাবে রাজস্ব আয় বাড়বে, তা ব্যাখ্যা করতে হবে, পূর্ববর্তী প্রকল্পের সাফল্যের প্রমাণ ও ব্যবহারিক উপকারিতা দেখাতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “এখন আর শুধু প্রকল্প অনুমোদন নয়, তার বাস্তবিক উপকারিতা ও অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নিশ্চিত করতেই হবে। জনগণের অর্থ অপচয় হওয়ার সুযোগ নেই। পায়রার মতো প্রকল্পে জবাবদিহি ছাড়া এক টাকাও খরচ করা চলবে না।”