দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এমনিতেই মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তারা আছেন হতাশায়, আস্থার সংকটে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা স্পষ্ট। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মসূচি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর কারণে পুরো দেশেই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে রাজস্ব আদায় ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
গত শনিবার প্রথমবারের মতো এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও আয়কর অফিসে একযোগে কর্মবিরতি পালন করা হয়। জমা পড়ছে না আয়কর রিটার্ন, বন্ধ ভ্যাট আদায়। আমদানি পণ্য খালাস বন্ধ, রপ্তানিমুখী পণ্যও আটকে আছে জাহাজে। রাজস্ব অফিসগুলোতে নেই কোনো কার্যক্রম। এতে পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, একদিনেই অন্তত ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে ধস নামবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এই শাটডাউন অর্থনীতির শ্বাসনালী চেপে ধরার মতো। রাজস্ব আদায় না হলে সরকারের কর্মকাণ্ডও থেমে যাবে।” তাঁর মতে, আলোচনা ছাড়া এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “এটি এমন সময় ঘটছে যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে অর্থনীতির গতি থেমে যাবে।”
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানান, “প্রতিদিন ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। সরকার সংকটের গুরুত্ব বুঝছে না। এনবিআরের অচলাবস্থা আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।” চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ। বিল অব এন্ট্রি, শুল্কায়নসহ সব কার্যক্রম স্থগিত। এতে বন্দরে কনটেইনার জটের আশঙ্কা বাড়ছে। বেনাপোলে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক আটকে আছে, যার বেশিরভাগই গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল বহন করছে। বেনাপোল বন্দরের পরিচালক জানিয়েছেন, খালি ট্রাকগুলো দেশে ফিরে যেতে পারছে, তবে বাণিজ্য একেবারে বন্ধ। হিলি বন্দরের অবস্থাও একই। ভারত থেকে আসা পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হিলি কাস্টমস অফিসেও কার্যত কাজ বন্ধ।
কর্মসূচি চলবে আজ রোববারও। শুধু আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের অপসারণের দাবিতেই এই আন্দোলন। শাস্তির হুমকিও কার্যত উপেক্ষা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জন্য এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। মে মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। জুন মাসেই আদায় করতে হবে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা—যা কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
রাজস্ব ভবনের সামনে জলকামান, পুলিশ, র্যাব, বিজিবির অবস্থান। সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে অনেক কর্মকর্তা নিজ অফিসে ঢুকতে পারেননি। ভবনের ভেতরে প্রবেশ ও বাহিরে যাতায়াতে ছিল বাধা। আন্দোলনকারীরা দিনভর স্লোগান দিয়েছেন চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা একবাক্যে বলছেন, এ সংকটের একমাত্র সমাধান আলোচনা। আপসহীন অবস্থান থেকে বেরিয়ে না এলে এই অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেবে। তাই সরকার ও আন্দোলনকারীদের উচিত দ্রুত একটি যৌক্তিক ও টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া।