আধুনিক সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে মানুষের ভোগবিলাস, শান-শওকত ও স্বাচ্ছন্দ্যের চাহিদা। এই চাহিদা পূরণের পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা যেসব বস্তু আবিষ্কার করেছি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্লাস্টিক। শুরুতে এটি ছিল সাশ্রয়ী, টেকসই ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য প্রশংসিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে এই প্লাস্টিকই আজ আমাদের জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য এক ভয়াবহ হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই এখন প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি। নদী, সমুদ্র, কৃষিজমি এমনকি আমাদের খাবার ও পানিতেও প্রবেশ করছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা মানুষসহ সমস্ত প্রাণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ পরিবেশ রক্ষা না করলে উন্নয়ন টেকসই হয় না—এটি এখন সর্বজনবিদিত সত্য। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি শুধু ভোগের পথে হাঁটবো, নাকি প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দেবো? সময় এসেছে আমাদের অগ্রাধিকার নতুন করে নির্ধারণ করার।
প্লাস্টিক আজ সুবিধা থেকে বিষে পরিণত: এক সময় প্লাস্টিক ছিল এক বিস্ময়কর আবিষ্কার—স্বল্প খরচে টেকসই, হালকা ও সহজলভ্য হওয়ায় এটি দ্রুতই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। থালা-বাসন, পানির বোতল, খাবার প্যাকেট, খেলনা, পলিথিন ব্যাগ থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম, গৃহস্থালি সামগ্রী, এমনকি বিদ্যুৎ ও নির্মাণ শিল্পেও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকহারে।
স্বাস্থ্যখাতে যেমন চিকিৎসা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি খাদ্য ও পণ্য পরিবহনে প্লাস্টিকের প্যাকেজিং বড় একটি বিপ্লব এনেছে। এর ব্যবহার যেমন আমাদের জীবনে সাশ্রয়ীতা ও সুবিধা এনেছে, তেমনি এর অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত ব্যবহার আজ ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছে।
প্লাস্টিকের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এটি অ-বায়োডিগ্রেডেবল—অর্থাৎ এটি মাটিতে মিশে যেতে ৪৫০ থেকে ১ হাজার বছর পর্যন্ত সময় নেয়। বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে, আর সেই সঙ্গে বাড়ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর একটি বড় অংশই সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার বা নিষ্পত্তি না হওয়ায় পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং মারাত্মক দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই শসমস্যা আরও প্রকট। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার বেশিরভাগই অব্যবস্থাপনার কারণে খাল, ড্রেন, নদী কিংবা রাস্তাঘাটে জমে থাকে। আবার দেশজুড়ে শহরাঞ্চলে গড়ে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ৮৭০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য, যার একটি বিরাট অংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য হলেও উপযুক্ত অবকাঠামো ও সচেতনতার অভাবে সেগুলো ঠিকভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে না।
ফলে এসব বর্জ্য মাটি, পানি ও প্রাণিকুলের জন্য ভয়াবহ হুমকি তৈরি করছে। এর সিংহভাগই রিসাইকেল করা হয় না। বরং এটি নদী ও সাগরে গিয়ে মিশে জলজ প্রাণীদের জীবনে হুমকি তৈরি করে এবং শেষপর্যন্ত সেই প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক সতর্কতামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, হরমোন বিকৃতি ও ক্যানসারের মতো জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয় সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে- মানব রক্ত, প্ল্যাসেন্টা এবং এমনকি নবজাতকের শরীরেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ।
প্লাস্টিক পোড়ালে যে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, তা বাতাসকে দূষিত করে এবং ফুসফুসজনিত নানা রোগ সৃষ্টি করে। আবার জমে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়, যা নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা ও জনস্বাস্থ্য সংকট বাড়িয়ে তোলে। এক কথায় স্বল্পমেয়াদে প্লাস্টিক সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি পরিবেশ ও মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রথম কাজ হবে প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাস করা।
নদী ও সাগর এখন প্লাস্টিকের ভাগাড়: বাংলাদেশের নদ-নদী বিশেষত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও কর্ণফুলীর অবস্থা দিন দিন আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে। এসব নদীতে দৃষ্টিগোচর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য ভেসে থাকতে দেখা যায়, যা মূলতঃ শহরের ড্রেনেজ ও কর্পোরেট বর্জ্য থেকে সরাসরি নদীতে এসে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার মোট কঠিন বর্জ্যের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশই প্লাস্টিক, যার অধিকাংশই রিসাইকেল না হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এই অব্যবস্থাপনার ফলে নদীর পানির মান যেমন অবনতির দিকে যাচ্ছে, তেমনি জলজ প্রাণীর জীবনও পড়ছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলের মাছের দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে—যা প্রমাণ করে, এই দূষণ ইতিমধ্যে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়েছে।
এই সংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়, বৈশ্বিকভাবেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের ৯০ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণের উৎস হিসেবে যে ১০টি নদীর কথা বলা হয়, তার মধ্যে কয়েকটি নদী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উদ্ভূত, যার মধ্যে বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ।
মূলতঃ নদী গুলো ভূমি থেকে সৃষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্যকে সমুদ্রে পৌঁছে দেওয়ার প্রধান বাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে সাগরের বিশাল জলজ বাস্তুতন্ত্রেও এই দূষণের প্রভাব পড়ছে সরাসরি। একবার যখন প্লাস্টিক সাগরে পৌঁছে যায়, তখন তা ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র কণায় ভেঙে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়, যা সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে শরীরে প্রবেশ করে এবং পরে মানুষের খাদ্যেও যুক্ত হয়।
বাংলাদেশে নদী ও সাগরের এই বাড়তে থাকা প্লাস্টিক দূষণ এখন শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়, বরং জনস্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি বিপজ্জনক সংকেত। এই প্রবণতা রোধে এখনই প্রয়োজন সচেতনতা, কঠোর নীতিমালা, কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নদী ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার।
নীতিনির্ধারণী উদ্যোগ কোথায়? প্লাস্টিক দূষণ রোধে সরকার ২০০২ সালেই পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তবে দুই দশক পার হলেও সেই নিষেধাজ্ঞার বাস্তব প্রয়োগ এখনো দৃশ্যমান নয়। শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে গ্রামীণ হাট-বাজার—সবখানেই পলিথিনের অবাধ ব্যবহার চোখে পড়ে। বাজারের সবজি মোড়ানো, খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, চিপসের মোড়ক, এমনকি শিশুদের খেলনার ক্ষেত্রেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রতিদিন বাড়ছে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে—নীতিনির্ধারণী উদ্যোগ কেবল কি ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অন্যদিকে বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই একবার ব্যবহারযোগ্য (Single-Use) প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে রুয়ান্ডা, কেনিয়া, চিলি, ফ্রান্স এবং ভারত উল্লেখযোগ্য। যারা আইন ও বাস্তবে প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছে।
বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগের প্রাথমিক প্রচেষ্টা দেখা গেলেও তা নিয়মিত নজরদারি, কার্যকর বাস্তবায়ন ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির অভাবে সফল হতে পারছে না। প্লাস্টিকমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কঠোরতা এবং নাগরিক দায়িত্বশীলতা—এই তিনটি দিকেই আরও জোর দিতে হবে।
সমাধান কী হতে পারে?
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে এখন আর শুধু আলোচনা নয়, দরকার সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম।
প্রথমতঃ বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পলিথিন ও নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং যথাযথ জরিমানার ব্যবস্থা করা জরুরি। শুধু আইন থাকলেই হবে না, এর বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সক্রিয়তাও জরুরি।দ্বিতীয়ত: প্লাস্টিকের বিকল্প উপকরণ যেমন: পাট, বাঁশ, কাগজ কিংবা কাচের ব্যবহারে ভোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। এসব উপকরণে প্যাকেজিং করলে পরিবেশ যেমন নিরাপদ থাকবে, তেমনি দেশের স্থানীয় শিল্পও উৎসাহ পাবে। উদ্যোক্তারা যাতে পরিবেশবান্ধব ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি করতে পারেন সেজন্য করছাড়, প্রণোদনা এবং সহজ অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
তৃতীয়ত: সচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই জীবনধারার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। প্রাথমিক স্তর থেকেই পরিবেশ-সচেতন নাগরিক গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই পরিবেশবান্ধব আচরণে অভ্যস্ত হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের প্রধান শহরগুলোতে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। প্লাস্টিক, জৈব ও অন্যান্য বর্জ্য আলাদা করে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ডাস্টবিন ও আধুনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে রিসাইক্লিং ব্যবস্থা কার্যকর হবে এবং প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে কমে আসবে।
প্লাস্টিক দূষণ এখন আর শুধু পরিবেশের সমস্যা নয়—এটি একটি জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে যার প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতিতেও। উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা কখনোই টেকসই হতে পারে না। কারণ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হলে উন্নয়নের ভিত্তিও ভেঙে পড়ে। আমাদের বুঝতে হবে—প্রকৃতি ছাড়া কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
প্লাস্টিক ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও এর অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত ব্যবহার আজ আমাদের নদী, মাটি, খাবার, এমনকি শরীর পর্যন্ত দূষিত করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন খাবারের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে আমাদের শরীরে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। তাই এখনই সময়—পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ধাপে ধাপে প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা।
এই পরিবর্তন আনতে হলে দরকার সরকারের কার্যকর আইন, শিল্পখাতের দায়িত্বশীলতা, নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা এবং প্রতিটি মানুষের সচেতন অংশগ্রহণ। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নীতিনির্ধারণ—সব কিছুতেই পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে শপথ করি—প্লাস্টিক নয়, প্রকৃতিই হোক আমাদের অগ্রাধিকার। এই প্রতিজ্ঞা থেকেই গড়ে উঠুক এক সবুজ, টেকসই ও প্রাণবান বাংলাদেশ।