মার্কিন শেয়ারবাজার নাসডাকে তালিকাভুক্ত হংকংভিত্তিক কোম্পানি রিজেনসেল বায়োসায়েন্স হোল্ডিংস এখন আলোচনার কেন্দ্রে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়ে যায় অবিশ্বাস্যভাবে—প্রায় ৮২,০০০ শতাংশ। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ইয়াত-গাই আউ কাগজে-কলমে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। তবে এই উত্থান ছিল ক্ষণস্থায়ী। শেয়ারদরের অস্বাভাবিক ওঠানামায় এখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের মুখে।
রিজেনসেল মূলত চীনের ঐতিহ্যবাহী ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তিতে মনোযোগ ঘাটতি ও অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের ওষুধ তৈরি করে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন প্রতিষ্ঠাতা আউ-এর বাবা সিক-কি আউ। তাঁদের তৈরি ‘ব্রেন থিওরি’ নামের ফর্মুলার একচেটিয়া মালিকানা রয়েছে রিজেনসেলের কাছে।
ছোট ও লোকসানি এই কোম্পানিটির শেয়ারদরের এমন লাফ সবাইকে অবাক করেছে। কোম্পানিটির ৮৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক স্বয়ং আউ। শেয়ারদরের রেকর্ড বৃদ্ধি তাঁকে হংকংয়ের অন্যতম শীর্ষ ধনীর কাতারে তুলেও নিয়ে যায়। তবে বিনিয়োগকারীদের সন্দেহ ও বিশ্লেষকদের প্রশ্ন এখন চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে একাধিক প্ল্যাটফর্ম বিষয়টি নিয়ে সরব। মর্নিং ব্রিউ এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “আমি তাহলে কি কিছু মিস করলাম?”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেন ‘পাম্প অ্যান্ড ডাম্প’ স্ক্যামের ইঙ্গিত দিতে পারে। এতে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে পরে দ্রুত বিক্রি করে প্রতারকেরা লাভবান হন।
পোর্ট শেল্টার ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হ্যারিস বলেন, “এটা একেবারে ক্লাসিক উদাহরণ অস্বাভাবিক শেয়ারবাজার আচরণের। তদন্তকারীদের এর দিকে অবশ্যই নজর যাবে।”
ইতোমধ্যে মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) বিদেশি বেসরকারি কোম্পানির সংজ্ঞা পরিবর্তনের বিষয়ে জনমত আহ্বান করেছে। এর ফলে রিজেনসেল হয়তো আর আগের মতো সুবিধা পাবে না—যেমন, ত্রৈমাসিক রিপোর্ট না দেওয়া বা নির্বাহীদের শেয়ার লেনদেনের তথ্য গোপন রাখা।
রিজেনসেল ২০২৩ ও ২০২৪ অর্থবছরে যথাক্রমে ৬.১ মিলিয়ন ও ৪.৪ মিলিয়ন ডলার লোকসান করেছে। কোম্পানির চিফ মেডিকেল অফিসার পদটিও গত দুই বছর ধরে খালি।
শেয়ারবাজারে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান আউ নিজেও বেশ আলোচিত। ছোটবেলায় পড়াশোনায় দুর্বল ও রাগী ছিলেন বলে একটি ভিডিওতে উল্লেখ করা হয়। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাস স্কুল অব বিজনেস থেকে পড়াশোনা করেছেন এবং একসময় ডয়েচে ব্যাংকে কাজ করতেন।
রিজেনসেল ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার সংখ্যা এখন অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি। মার্কিন ও এশিয়ার টেলর সুইফট কনসার্টে ফ্রি টিকিট দেওয়ার মতো কৌশল ব্যবহার করেছে তারা। বিপরীতে হংকংয়ের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বিওয়ান মেডিসিনস-এর ফলোয়ার মাত্র আড়াই হাজার।
রিজেনসেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ডিজিটাল মোবাইল ভেঞ্চার, যেটির মালিকানা রয়েছে তাইওয়ানের স্যামুয়েল চেন ও তাঁর স্ত্রী ফিওনা চ্যাং-এর হাতে। চেন জুম ভিডিও প্ল্যাটফর্মে প্রাথমিক বিনিয়োগ করেছিলেন এবং মহামারির সময় বড় ধরনের মুনাফা অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ক্যানসার চিকিৎসা ও চিপ প্রস্তুতকারক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেরও শীর্ষ শেয়ারহোল্ডার।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রস স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক এরিক গর্ডন জানান, এখন আর অস্বাভাবিক লেনদেন ম্যানুয়ালি নজরদারি করতে হয় না। এসইসি ও ফিনরা স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে এসব চিহ্নিত করে কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহি করাতে পারে।
তবে তাঁর মতে, লোকসান করলেই কোনো কোম্পানি সন্দেহজনক হয়ে যায় না। কিন্তু শেয়ারের আচরণ যদি অস্বাভাবিক হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ।
রিজেনসেল এখন পর্যন্ত শেয়ারের দাম বা ইয়াত-গাই আউ-এর সম্পদ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্তেই পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হবে।