বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি মুদ্রানীতির ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। উচ্চ সুদ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে আসছেন। এর ফলে উৎপাদন ও শিল্পখাতও স্থবির হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের মে মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৯৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১০.৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩.১৪ শতাংশ। এটি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন প্রবৃদ্ধির হার। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৭.১৫ শতাংশ, আর করোনা-পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের মে মাসে নেমে গিয়েছিল ৭.৫৫ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে ৯.৮০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে তা অনেক নিচে অবস্থান করছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এর প্রভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশে। একসময় এই হার ছিল ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এই উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে গেছে, ফলে মুনাফা কমে যাচ্ছে এবং বিনিয়োগের ঝুঁকি বাড়ছে। উদ্যোক্তারা নিরাপদ মনে করছেন সঞ্চয় কিংবা নগদ অর্থ ধরে রাখাকে। এর ফলে বিনিয়োগপ্রবণতা কমছে এবং ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ স্থবির হয়ে পড়েছে।
রাজস্ব আয় কম থাকায় সরকার বর্তমানে ব্যাংক খাত থেকেই বিপুল ঋণ নিচ্ছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণ পূরণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যার ফলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থায়ন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অর্থনীতিতে এ অবস্থাকে বলা হয় ক্রেডিট ডিসপ্লেসমেন্ট। যদিও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে, কিন্তু সরকারের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতে নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে সার্বিক অভ্যন্তরীণ ঋণের হার কমেছে, যা অর্থনীতিতে দ্বিমুখী চাপের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, “কঠোর মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে। উচ্চ সুদ বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। ফলে অর্থনৈতিক গতি মন্থর হয়ে পড়ছে।” তিনি আরও বলেন, “রাজস্ব আয় বাড়ানো, বাজেট ঘাটতি কমানো এবং বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সহজলভ্যতা তৈরি করা জরুরি। না হলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বড় বাধা আসবে।”
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রবণতা বজায় থাকলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হুমকির মুখে পড়বে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এমন সুষম নীতি গ্রহণ করা, যা একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধিও বজায় রাখবে।15