গরু জবাইয়ের পর আমরা সাধারণত মাংসকেই মূল্যবান ভাবি। কিন্তু গরুর লিঙ্গ—যাকে বুলস্টিক বলা হয়—তা দিয়েই বানানো হচ্ছে উচ্চমূল্যের কুকুরের খাবার। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এ পণ্যের রয়েছে বড় বাজার। অথচ দেশে গরু জবাইয়ের পর অবশিষ্টাংশের বেশিরভাগই ফেলা হয় ভাগাড়ে। অথচ গরুর যৌনাঙ্গ, রক্ত, হাড়, শিং, লেজের লোম, ভুঁড়ি ও চর্বি—সব কিছুই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে নয়টি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত বুলস্টিক রপ্তানি করছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে শুধু মে মাসেই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। মানভেদে প্রতি কেজির দাম ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠানামা করে। এই পণ্য রপ্তানির ৬০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, আর ৪০ শতাংশ যায় কানাডায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নীতির কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
গরু বা মহিষের যৌনাঙ্গ রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব—তা অনেকেই জানেন না। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ২ হাজার কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার কেজি, যার মূল্য ছিল ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তখন রপ্তানিতে ১০–১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও বর্তমানে তা কমে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে অনেক রপ্তানিকারক আগ্রহ হারাচ্ছেন।
রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করছেন, চীনের কিছু ব্যবসায়ী কাঁচা বুলস্টিক কম দামে রপ্তানি করায় দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। একই সঙ্গে দেশীয় বাজারে কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। তাঁদের মতে, গরু জবাইয়ের আগে যদি ম্যাডকাউ ডিজিজ প্রতিরোধে বিএসই সার্টিফিকেট দেওয়া যায়, তবে ইউরোপের বাজারেও এই পণ্য সহজেই রপ্তানি করা যাবে।
রপ্তানিযোগ্য বুলস্টিক প্রস্তুতের জন্য গরু জবাইয়ের পর যৌনাঙ্গ সংগ্রহ করে তা ফ্রিজারে সংরক্ষণ করতে হয়। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে চামড়া, চর্বি ও মূত্রনালি আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়। তারপর তা বাণিজ্যিক ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৬০ মিনিট শুকানো হয়। কিছু ক্ষেত্রে রোদে শুকানো হলেও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ঝুঁকি থাকে। শুকানোর পর আর্দ্রতা ৫–১০ শতাংশের মধ্যে রাখতে হয়। এরপর স্বাস্থ্যসনদ ও রপ্তানি ছাড়পত্র নিয়ে নির্দিষ্ট মাপ (৬ ও ১২ ইঞ্চি) কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করে রপ্তানি করা হয়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক কোটির বেশি গরু ও মহিষ জবাই হয়। এসব পশুর বুলস্টিক সংগ্রহ করে বিক্রি করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। যেমন, সাভারের হেমায়েতপুরের মানিক মিয়া রহমান প্রতি মাসে বরিশাল, কুষ্টিয়া ও আশপাশের ১৫ জেলার কসাইদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ১৭ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন। এতে তাঁর মাসিক আয় হয় ১ থেকে ১.২০ লাখ টাকা।
সিরাজগঞ্জের এমদাদুল হক সাত বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন। প্রতি মাসে ৪০ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করে আয় করেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। উত্তরবঙ্গের ২০টি জেলা থেকে সংগ্রহ করা পণ্য তিনি কেজি হিসেবে বিক্রি করেন—২৫০ গ্রামের নিচে ৩০০–৩৫০ টাকা এবং ৩০০ গ্রামের বেশি ওজনের বুলস্টিক ৩৮০–৪০০ টাকায়। তবে মান ও আকৃতি ভেদে দামে তারতম্য হয়।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে বুলস্টিক রপ্তানিতে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল ‘ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডস’। প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রতি মাসে গড়ে দেড় টন বুলস্টিক রপ্তানি করছে। এর পরিচালক আবিদ আজাদ জানান, একটি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে ব্যবসা আরও সংগঠিতভাবে পরিচালিত হয়। তাঁর মতে, প্রণোদনা বাড়ানো হলে নতুন উদ্যোক্তারাও যুক্ত হবেন।
অন্যদিকে, এম এম রাইয়ান ট্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল হাসান জানান, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে হলে গামা রেডিয়েশন বাধ্যতামূলক। এটি দেশে করে দেয় সাভারের পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তবে সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস। এ সময় কমানো গেলে রপ্তানি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, সঠিক পদ্ধতিতে বুলস্টিক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা গেলে ইউরোপের বাজারও ধরা সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, বিএসই ও আইএসও সার্টিফিকেটের জন্য আগে ‘গুড ল্যাব প্র্যাকটিস প্রোগ্রাম’ (জিএলপিপি) চালু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। কিন্তু অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি থমকে গেছে। এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করা।