নির্ভরযোগ্য শিল্প খাত ছাড়া কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, আর বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। গত কয়েক দশকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে শিল্পখাতে উত্তরণ শুরু হলেও, বাংলাদেশের এই শিল্পায়ন প্রক্রিয়া এখনো নানা বাধার সম্মুখীন। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং দক্ষ জনবলের অভাবের মতো নানা সমস্যার কারণে দেশের শিল্পখাত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশের শিল্পায়নের বর্তমান অবস্থা ও এর প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধানের পথ খোঁজা দেশেরই উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোনো একটি অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা কৃষিভিত্তিক থেকে ক্রমশ শিল্পভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলে তাকে শিল্পায়ন বলে। শিল্পায়ন হল একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। কারণ এর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিল্পায়নের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। শিল্পায়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। শিল্প খাত একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে একটি দেশের উৎপাদন ক্ষমতা, আয় ও দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) এর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এছাড়া শিল্প খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির তুলনায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে শিল্পায়ন বেকারত্ব হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন বাংলাদেশের একটি শিল্প খাত, পোশাক খাতে কয়েক মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করে।
শিল্প পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এমনকি কৃষি খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায় তার থেকেও বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশ যে যে শিল্পপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সেগুলো হলো পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য ইত্যাদি।এই মুদ্রা দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমায়।
মূলত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়, যা জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে।
শিল্প খাতের বিকাশের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটে, এর ফলে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন খরচ কমে যায়। শিল্প খাতে প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গঠন ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারও শিল্পায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
শিল্পায়ন কৃষিপ্রধান শিল্পের তুলনায় দেশীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের শিল্প খাত যত উন্নত, বিনিয়োগকারীরাও তাতে তত বেশি আকৃষ্ট হন। বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো শক্তিশালী হয়। এছাড়া, বিনিয়োগ বাড়ার ফলে দেশের বৈদেশিক বিনিময় রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমে। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উন্নত দেশের দিকে ধাবিত হবার পথের জন্য আবশ্যক।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে শিল্প খাতকে আরও আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ইতিমধ্যে বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করেছে। তবে, শুধুমাত্র এক বা দুইটি খাতে নির্ভর না করে বিভিন্ন শিল্প খাতের বিকাশ ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আইসিটি, ইলেকট্রনিক্স, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতের বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের আরও দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
শিল্প খাতের উন্নয়ন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা দূরীকরণ এবং মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শিল্পায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।শিল্পায়নের মাধ্যমে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হয়। বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করা এবং বাজার বৈচিত্র্যকরণের জন্য বাংলাদেশ শিল্প খাতকে লাভজনকভাবে ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশি শিল্পপণ্যের চাহিদা বাড়ছে, যা রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
বর্তমান বিশ্বে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের (global supply chain) ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে। এতে করে দেশের উৎপাদিত পণ্যগুলো সহজে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারে, এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে। এভাবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিল্পায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং উন্নয়নের পথকে আরও সুগম করতে পারে।
শিল্পায়নের প্রধান ভিত্তি হলো অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ। কিন্তু বাংলাদেশের এক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করতে পারে না। দেশে জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে এবং শিল্পের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
আবার শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, বন্দর এবং পরিবহন ব্যবস্থা এখনও অনেক দুর্বল। বিশেষত দেশের অভ্যন্তরীণ রেল ও সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। শিল্প পণ্যের আমদানি ও রপ্তানি সময়মতো না হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং এদেশের ব্যবসায়ীরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন।
শিল্প স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত জমির অভাব বাংলাদেশের শিল্পায়নের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জমি অধিগ্রহণে চরম সমস্যার মুখোমুখি হয়। অধিক জমির দাম এবং জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এছাড়া, জমির জটিলতার কারণে শিল্পকারখানা স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়।
দক্ষ মানবসম্পদ শিল্প খাতের বিকাশের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। যদিও বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশাল, কিন্তু বাংলাদেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব থাকায় দক্ষ শ্রমশক্তির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনশীলতার ঘাটতি পূরণ করতে পারে না এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকেন।
বাংলাদেশের শিল্প খাতের বড় অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দ্বারা গঠিত। কিন্তু, এসব প্রতিষ্ঠান প্রায়ই পর্যাপ্ত অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হয়। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার এবং ঋণ প্রদানের জটিল প্রক্রিয়া শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাই শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তব বিষয় হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের দ্বন্দ্ব । যা বাংলাদেশের শিল্প খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রায়শই রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, ধর্মঘট এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই ধরনের অস্থির পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য অনিরাপত্তার সৃষ্টি করে, যা শিল্প খাতের প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বলে অর্থনীতিতে শিল্পখাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
শিল্পখাতে এদেশের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনো পুরনো ও অপ্রচলিত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে প্রযুক্তির উন্নয়ন অপরিহার্য। তবে, দেশে যথাযথ গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রমের অভাবে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া, শিল্প খাতে গবেষণার জন্য যথেষ্ট তহবিলের অভাব এবং প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতাও এদেশের শিল্প খাতে উন্নতিতে অনেকাংশে বাধা তৈরি করছে। অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যা আমদানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করে। এই নির্ভরতা আমদানি খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি শিল্প পণ্যের মূল্যে প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব, ব্যাপক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সরকারি দপ্তরগুলোতে অনৈতিক কর্মকাণ্ড শিল্পের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, সেগুলো সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও কিছু গুরুতর বাধা এখনো অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করে দিচ্ছে। এজন্য অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, প্রশাসনিক জটিলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি – এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। যথাযথ নীতি সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এ ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করলে আশা করা যায় যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সক্ষম হবে।
কলামিস্ট : কাজী হেলাল