বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম সেপ্টেম্বরে অতীত ১৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। চাল ছাড়া প্রায় সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যের মূল্যই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) শুক্রবার তাদের মাসভিত্তিক মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে, যেখানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এফএওর এই সূচক আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বাধিক বাণিজ্য হওয়া খাদ্যপণ্যের দামের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে খাদ্যপণ্যের গড় মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১২৪ দশমিক ৪ পয়েন্টে, যা আগস্টের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ সংকটের সঙ্গে এই দাম বৃদ্ধি সরাসরি সম্পর্কিত, যা বাজারে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
বিশ্বের শীর্ষ চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলে সাম্প্রতিক দাবানল আখ উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে ভারত, বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ চিনি উৎপাদক, ইথানল উৎপাদনের জন্য আখ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, যার ফলে রফতানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে সেপ্টেম্বরে চিনির মূল্যসূচক বেড়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, যা এই সময়ে মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ।
গম এবং ভুট্টার দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে গম উৎপাদন ব্যাহত হয়, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বৃদ্ধি পায়। তবে কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
একই সময়ে, ব্রাজিলের মাদেইরা নদী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদীতে পানির স্তর কমে যাওয়ায় ভুট্টা পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে বাজারে। ফলে ভুট্টার দামও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামও সেপ্টেম্বরে বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশেষত পাম অয়েল, সয়াবিন, সূর্যমুখী এবং সরিষা তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিনের মাড়াই কমে যাওয়ায় তেলের দাম আরও বেড়ে যায়, যা ভোজ্যতেলের মূল্যসূচককে আরও ঊর্ধ্বমুখী করেছে।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী চালের দাম কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বরে চালের মূল্যসূচক দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পায়, যা খাদ্যবাজারে একমাত্র ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা গেছে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের স্থবিরতা এবং চাহিদার নিম্নমুখী চাপের কারণে চালের দাম কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও জাতিসংঘের সংস্থা এফএও চলতি বছরের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পূর্বাভাস সংশোধন করেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য উৎপাদন ২৮৫ কোটি ৩০ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে, যা কিছুটা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। গম ও চাল উৎপাদনের সম্ভাব্য বৃদ্ধির ফলে এফএও এই পূর্বাভাস দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী চাল উৎপাদন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ৫৩ কোটি ৯২ লাখ টনে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সময়ে খাদ্যশস্যের ব্যবহার বেড়ে ২৮৫ কোটি ৩০ লাখ টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা মোট ব্যবহারের দিক থেকে দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া, শস্যের মজুদও ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতা বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্টি হয়েছে, যা সরবরাহ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় আরও চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। বিশেষ করে, চালের মূল্য কমলেও অন্যান্য প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে, যা খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।