গত ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ভোরে ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের তিনটি প্রদেশের সামরিক স্থাপনাগুলি। এই হামলা তিন দফায় সম্পন্ন হয়েছে এবং ইসরায়েল দাবি করছে, এটি ১ অক্টোবর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব। ইসরায়েলিরা ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
ইরান সরকার হামলার পর জানিয়েছে, এই হামলায় অন্তত দুজন সেনাসদস্য নিহত হয়েছে এবং সীমিত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। ইরানের কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা আত্মরক্ষার অধিকার রাখে এবং ইসরায়েলের এসব আগ্রাসনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। হামলার পরে ইরান সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা হামলার জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।
গত শনিবার ভোররাতে ইসরায়েল কীভাবে এবং কখন এই হামলা চালিয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, তেহরান, কারাজ এবং মাশহাদ শহরে অন্তত সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। হামলার শুরুতে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তবে ইসরায়েল তেলক্ষেত্র বা পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলা চালায়নি।
হামলার পরিকল্পনা ও ইসরায়েলের বক্তব্য-
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী শনিবার ভোরে হামলার সফলতার কথা জানিয়ে বলেছে, ইরানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন উৎপাদনকারী স্থানগুলোতে হামলা চালানো হয়েছে। তাদের হামলার সাংকেতিক নাম ছিল ‘ডে’স অব রিপেনট্যান্স’ বা অনুতাপের দিন। এই অপারেশনে বহু যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয় এবং হামলার পরে সব যুদ্ধবিমান নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট হামলার পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করেন, যা একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে বসে করা হয়। এটি ইসরায়েলের পক্ষ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কারণ এর আগে তারা ইরানে হামলা চালানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।
ইরানের প্রতিক্রিয়া-
ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হামলায় সীমিত ক্ষয়ক্ষতির কথা জানানো হলেও সামরিক স্থাপনাগুলোতে তেমন ক্ষতি হয়নি। দেশটির সামরিক কর্মকর্তারা হামলার পরে স্বীকার করেছেন, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল এবং তারা হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল।
আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, হামলায় ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছিল, তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এই হামলা তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর আক্রমণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা-
হামলার পূর্বে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছিল, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলায় কোনো ভূমিকা নেয়নি। বাইডেন প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইরানে ইসরায়েলের হামলাকে ‘সুনির্দিষ্ট ও আনুপাতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ইসরায়েলকে পরামর্শ দিয়েছেন, যেকোনো আগ্রাসনের পরে সরাসরি পাল্টা হামলা থেকে বিরত থাকতে।
তবে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন, কারণ ইরান হামলার জবাব দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানের পাল্টা হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য তারা প্রস্তুত।
হামলার কারণ-
ইসরায়েলের বিমান হামলার পিছনে মূল কারণ হিসেবে ১ অক্টোবর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সময় ইরান, হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ছিল। এই হামলার বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ভূপাতিত করা হয়।
ইসরায়েল সরকার এই হামলার পর ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করে এবং হামলার একটি বড় জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, ইসরায়েল ইরানের তেল এবং পারমাণবিক স্থাপনাসমূহে হামলা চালাতে পারে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের হামলার পরিকল্পনায় সমর্থন দেয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেন, তারা যেন ইরানের তেল ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বদলে অন্যান্য সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই কারণে ইসরায়েল সীমিত আক্রমণের পরিকল্পনা করে, যা ‘ডেস অব রিপেনট্যান্স’ নামে পরিচিত হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া-
ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এসেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানিয়েছেন, ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি রোধে সবাইকে কাজ করতে হবে।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলার পরে বলেছে, ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের উসকানি ও পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া সৌদি আরব হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক আইন এবং নীতির লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে নিন্দা জানিয়েছে। মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, হামাস, হিজবুল্লাহ, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতারা ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া-
ইরান সরকারের পক্ষ থেকে হামলার পরে বিভিন্ন মন্তব্য এসেছে। ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে তাদের। হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) জানিয়েছে, তারা হামলার প্রেক্ষাপটে পাল্টা হামলা চালাতে প্রস্তুত।
তবে ইরানের সামরিক বিশ্লেষকরা গত বৃহস্পতিবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইসরায়েলের হামলাকে ‘সীমিত’ মনে হলে এবং তাতে হতাহত না হলে ইরানের পাল্টা হামলা চালানোর সম্ভাবনা কম।
একদিকে, ইরানের নেতা ও সেনাবাহিনী নিজেদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর মাধ্যমে উন্মুক্তভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরলেও, তারা এখনো স্পষ্টভাবে কোনো আক্রমণ পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি।
হামলার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব-
ইসরায়েলের বিমান হামলার পর সৃষ্ট পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, হামলার ফলে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছাতে পারে, যা ইতিমধ্যেই চরম উত্তেজনায় রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে ইরান তাদের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে ইসরায়েলকে দেখার কারণে, এই হামলার জবাবে পাল্টা হামলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয়ত, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেও আরও বর্ধিত করতে পারে। ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এবং অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি নতুন যুদ্ধের সূচনা করতে পারে, যা গোটা অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েল যদি দীর্ঘমেয়াদি হামলার পরিকল্পনা তৈরি করে, তাহলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। মার্কিন প্রশাসন ইতিমধ্যেই এই হামলার ব্যাপারে ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়েছে এবং তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। ইসরায়েল যদি আবারও আক্রমণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সম্ভাব্য পরিস্থিতি-
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার মাঝে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। ইরান, যেহেতু তাদের আত্মরক্ষার অধিকার দাবি করছে, তাই তারা প্রতিক্রিয়া জানালে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইরান সীমিত আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে বার্তা দিতে পারে কিন্তু তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরকে আকৃষ্ট করতে পারে।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোও ইরানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। এই হামলার পর বিশ্বরাজনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, তা কেবল দুই দেশের সম্পর্ককেই নয় বরং গোটা অঞ্চলের রাজনৈতিক গতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
অতীতে সংঘটিত এই বিমান হামলার ফলাফল ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে পরিবর্তন করতে পারে। হামলার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং সামরিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আসন্ন দিনগুলোতে পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। আগামী দিনগুলোতে যদি পরিস্থিতি উত্তেজনার দিকে মোড় নেয়, তবে এটি পুরো অঞ্চলের জন্য এক নতুন অশান্তির সূচনা করতে পারে।
এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘ডেস অব রিপেনট্যান্স’ হামলা এবং এর প্রভাব। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি কার্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি।