ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের ছোট শহর নন্দা নগরের এক কোণে নন্দাকিনী নদীর তীরে আছে একটি গোলাপি রঙের ড্রাই-ক্লিনিং দোকান। প্রতিদিন সকাল ৮টায় দোকানটি খোলেন ৪৯ বছর বয়সী আহমদ হাসান। দোকানে প্লাস্টিকে মোড়ানো কাপড় সাজিয়ে রেখে তিনি বসে থাকেন। অপেক্ষা করেন গ্রাহকদের জন্য।
আগে দুপুরের মধ্যেই দোকানে ভিড় জমত। দিনে ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক আসতেন। কেউ শেরওয়ানি আনতেন কেউ কোট-প্যান্ট বা শীতের কাপড়। হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে আসতেন সবাই। কাপড় দেওয়ার সময় চা খেতেন গল্প করতেন। রাজনীতির কথাও উঠত। তখন সম্পর্ক ছিল সহজ হাসিখুশি।
এখন দৃশ্যটা পাল্টে গেছে। দিনে পাঁচজন হিন্দু গ্রাহকও আসেন না। মুসলিম তো কেউই নেই। কারণ নন্দা নগরে এখন আহমদ হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। তার মতের অন্য সবাই শহর ছেড়ে চলে গেছেন।
নন্দা নগরে আগে ১৫টি মুসলিম পরিবার থাকত। সবার সঙ্গেই ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। হাসানের পরিবার হিন্দুদের উৎসবে যেত। ঈদে হিন্দু বন্ধুরা আসত তাদের বাড়ি। তিনি নিজেও অনেক হিন্দু বন্ধুর দাহে কাঠ জোগাড় করেছেন। মরদেহ কাঁধে তুলেছেন।
সবকিছু বদলে যায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এক হিন্দু ছাত্রী স্থানীয় মুসলিম নাপিত মোহাম্মদ আরিফের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এর পর আরিফ পালিয়ে যান। শহরে ছড়ায় উত্তেজনা।
১ সেপ্টেম্বর দোকানদার সমিতির ডাকে একটি সমাবেশ হয়। মুসলিমরাও সেখানে যোগ দেন। না গেলে অভিযোগ উঠত তারা অপরাধীকে সমর্থন করছেন।
সমাবেশে গিয়েই বিপদ হয়। সেখানে স্লোগান ওঠে—“মুল্লোঁ কে দালালোঁ কো… জুতে মারো সালো কো।” জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। থানার সামনে এক মুসলিম যুবক হারুন আনসারিকে মারধর করা হয়। বলা হয় মুসলিমরা আরিফকে পালাতে সাহায্য করেছে।
এরপর ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। শতাধিক লোক মুসলিমদের বাড়িতে ইট ছোড়ে। দোকান ভাঙচুর করে। হাসানের দোকানের শাটার ভাঙে। কাপড় ছড়িয়ে পড়ে। কাউন্টারে রাখা ৪ লক্ষ রুপি চুরি হয়। এই টাকা ছিল সন্তানের বিয়ের জন্য জমানো। দোকানের সাইনবোর্ড নদীর ধারে পড়ে ছিল ছিন্নভিন্ন।
পরদিন ২ সেপ্টেম্বর, উগ্র হিন্দু ডানপন্থীরা আবার বিক্ষোভ করে। সেখানে বক্তৃতা দেন দর্শন ভারতী নামে এক নেতা। তার বক্তব্যের পর জনতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মুসলিমদের বাড়ি, একটি অস্থায়ী মসজিদ ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। হাসানের বাড়ি ছিল একমাত্র বহুতল ভবন। সেদিন সব মুসলিম পরিবার সেখানে আশ্রয় নেয়।
সেদিনই আরিফকে উত্তরপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু পুলিশ মুসলিমদের জানিয়ে দেয়—তারা আর নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সেই রাতেই পুলিশ তাদের গাড়িতে করে মুসলিম পরিবারগুলোকে পার্শ্ববর্তী এক শহরে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। এইভাবেই নন্দা নগর ছেড়ে চলে যায় বাকি সব মুসলিম পরিবার।
হাসান ও তার পরিবারও ২৬৬ কিলোমিটার দূরে দেরাদুনে আশ্রয় নেন। ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি ও মোহাম্মদ আয়ুম হাইকোর্টে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন। আদালত নির্দেশ দেয়—আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। এরপর হাসানের স্ত্রী সাহস দেখান। তিনি সন্তানদের নিয়ে শহরে ফিরে আসেন। বলেন, “না ফিরলে সব হারাব।”
১৬ অক্টোবর হাসান ফিরে এসে দেখেন, তার দোকানের ঠিক উল্টো পাশে এক হিন্দু ব্যক্তি নতুন ড্রাই-ক্লিনিং দোকান খুলেছেন। স্থানীয়রা তখন মুসলিমদের পুরোপুরি বয়কট করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা সবাইকে বলে দিয়েছে—মুসলিমদের কোনো সাহায্য করা যাবে না।
হাসান নিজ হাতে দোকান মেরামত করেন। আবার চালু করেন ব্যবসা। কিন্তু আগের মতো আর কেউ আসেন না। পুরনো গ্রাহকরা ফোনেও উত্তর দেন না। হাসান বলেন, “সেই দিন আমি বুঝলাম, ড্রাই-ক্লিনিংয়েরও একটা ধর্ম আছে।”
এই বৈষম্যের বোঝা শুধু হাসান নয়, তার সন্তানরাও বইছে। তার ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে এক সহপাঠী বলেছিল, “তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া উচিত, কারণ সে মুসলিম।” পরে স্কুলের প্রিন্সিপাল হস্তক্ষেপ করলে হয়রানি বন্ধ হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জয় সিং নেগি নিজে হামলার সাক্ষী ছিলেন। তিনি একটি এফআইআর করেন। সেখানে লেখা আছে হামলাটি ছিল পরিকল্পিত এবং ভয়ংকর। কিন্তু এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি। পুলিশও কোনো মন্তব্য করেনি।
নন্দা নগরের ঘটনা শুধু স্থানীয় নয়। এটি একটি বড় সংকেত। উত্তরাখণ্ডসহ ভারতের অনেক শহরে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে।
বিজেপির নেতৃত্বে উগ্র ডানপন্থীরা নানা জায়গায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বয়কট চালাচ্ছে। দোকান জ্বালিয়ে দিচ্ছে। শারীরিক হামলাও করছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও নন্দা নগর ছাড়তে চান না আহমদ হাসান। তিনি বলেন, “এই শহরই আমার একমাত্র বাড়ি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকব।”
কিন্তু প্রতিদিন তাকে কাটাতে হয় ভয়ে আর নিঃসঙ্গতায়। পরিচিত মুখগুলো এখন আর পাশে নেই। হিন্দু প্রতিবেশীরা কথা বলেন না। তিনি সন্ধ্যায় নদীর ধারে হাঁটতে যান না। স্ত্রী-সন্তানদের কাউকে একা বাইরে যেতে দেন না। তার জীবন থেমে আছে এক রকম।
তবুও তিনি দোকানে বসে থাকেন। অপেক্ষা করেন—কেউ হয়তো কাপড় নিয়ে আসবে। হয়তো পুরনো কোনো বন্ধু এক কাপ চা খেতে পাশে বসবে। অথবা হয়তো কোনো একদিন নন্দা নগরে আবার ফিরবে সেই পুরোনো মিলেমিশে থাকার দিন।