১২ দিনের ইরান যুদ্ধ ছিল নজিরবিহীন—ভৌগলিক বিস্তৃতি, কৌশলগত গভীরতা ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যে অনন্য। এই প্রথমবার, ইসরায়েল এমন এক দেশের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ চালাল যার সঙ্গে তার কোনো সীমানা নেই—যার দূরত্ব কমপক্ষে ১,৫০০ কিলোমিটার। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—এই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে সরাসরি একটি সামরিক হামলায় অংশ নেয়।
যুগপৎ প্রশিক্ষণ, সমন্বয় ও সহমিলনের বহু দশকের প্রস্তুতির পর সেই মুহূর্ত এলো। দৃশ্যপটে ছিল এক নিখুঁত যৌথশক্তির প্রদর্শনী। কিন্তু এই জোটের শক্তির মহড়া আসলে যা প্রকাশ করল, তা হলো একটি ভঙ্গুরতা, এক প্রকার নির্ভরশীলতা এবং এমন এক ক্ষমতার কাঠামো যা নিজস্ব মিথের ওজনে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল বহুদিন ধরেই পশ্চিমা সহায়তার উপর নির্ভর করে এসেছে—রাজনৈতিক, সামরিক এবং আর্থিকভাবে। তবে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ যুদ্ধ ব্যতীত, ইসরায়েল প্রায় সব বড় যুদ্ধে সরাসরি নিজেই অংশগ্রহণ করেছে।
আজ যা পরিবর্তিত হয়েছে, তা হলো এই নির্ভরশীলতার স্বরূপ আর আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। আগে যা কূটনৈতিক ভাষায় আড়ালে থাকত, তা আজ স্পষ্ট ও উন্মোচিত।
১৯৪৮ সালে, যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সদ্যঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন, তখন তার প্রশাসনের ভেতরেই তীব্র মতবিরোধ ছিল। অনেকে সতর্ক করেছিলেন, এই “উপনিবেশিক রাষ্ট্র” আরব-ইসলামিক অঞ্চলে ভবিষ্যতে এক দুঃসহ সংকট তৈরি করবে।
ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিল ইসরায়েলের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের চাপেই তারা পিছু হটে। সেই পট পরিবর্তন আসে লিন্ডন জনসনের আমলে, যিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রথমবার ইসরায়েলকে আক্রমণাত্মক অস্ত্র দেয়ার অনুমোদন দেন।
সেখান থেকেই গড়ায় এক গভীর সুরক্ষা-সম্পর্ক—ওয়াশিংটন শুধু মিত্র নয়, হয়ে ওঠে ইসরায়েল প্রকল্পের ঢাল ও তলোয়ার।
১৯৬৭ সালে মার্কিন অস্ত্রে ইসরায়েল ছয় দিনে সিনাই, পশ্চিম তীর ও গোলান মালভূমি দখল করে। ১৯৭৩ সালে মিশর-সিরিয়া আক্রমণের সময়ও আমেরিকা বিপুল অস্ত্র ও সাহায্য পাঠায়। কিন্তু তবুও, সরাসরি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।
১৯৯১ সালে ইরাকে যুদ্ধ চলাকালে, আমেরিকা ইসরায়েলকে পাল্টা আক্রমণ করতে দেয়নি। এমনকি ২০০৩ সালে আমেরিকা-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল উপকৃত হলেও তাদের বাইরে রাখা হয়—স্বাধীনতার মিথ ধরে রাখতে।
কিন্তু এবার—ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করল, আর যুক্তরাষ্ট্র এতে সরাসরি অংশ নিল। পুরো দুনিয়ার সামনে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
এটা ইসরায়েলের শক্তি নয়, বরং দুর্বলতা প্রকাশের মুহূর্ত।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল। লেবানন, সিরিয়া—সবখানেই বোমাবর্ষণ করেছে। কিন্তু যখন ইরান পাল্টা আঘাত হানে, তখন ইসরায়েল একা কিছু করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার শরণাপন্ন হয়। আমেরিকাও আগেভাগে প্রস্তুত ছিল—ইরান হামলার মহড়া দিয়েছিল তারা এক বছর আগেই।
ইসরায়েল একা লড়তে পারে না—এ সত্য এবার ঢাকঢোল পিটিয়েই প্রকাশ পেল।
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ইসরায়েলের ওপর নির্ভরতাও নতুন রূপ পেল। ১৯৬৭ সালে যেমন ইসরায়েল একা জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল, আজ তেমন কিছুই নেই। বরং, যুদ্ধ শেষে যখন ইসরায়েল আরেকবার হামলা করতে চাইল, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে তাদের থামিয়ে দিলেন।
পাইলটদের পিছু ডাক দেওয়া হলো। নেতানিয়াহুকে অপমানজনক ভাষায় সম্বোধন করলেন প্রেসিডেন্ট নিজেই।
এটাই সেই সত্য—নির্ভরতা মানেই সার্বভৌমত্ব বিসর্জন।
যে শক্তির মহড়া চালানো হয়েছিল, তা পরিণত হলো এক আত্ম-স্বীকারোক্তিতে। বিজয় নয়, ভঙ্গুরতার নগ্ন প্রকাশ।
যত বেশি আগ্রাসন, তত গভীর প্রতিরোধ। এই ভূখণ্ড শত শত বছর ধরে আগ্রাসনের শিকার হয়েছে—ক্রুসেডার, ব্রিটিশ, ফরাসি, আমেরিকান—সবাই এসেছে। সবাই গেছে। প্রতিবার প্রতিরোধ উঠেছে আরও দৃঢ় হয়ে।
গাজা এখন এক প্রতীক। পুড়ছে, ক্ষুধার্ত, ঘেরাও—তবু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ঠিক পরেই গাজায় হামলায় ৭ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়—বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়, প্রতিরোধ এখনো থেমে যায়নি।
১৯৬৭ সালে তিনটি আরব সেনাবাহিনী ছয় দিনে ধসে পড়ে। ১৯৮২ সালে পিএলও বেরিয়ে যায় বৈরুত থেকে দুই মাসের মাথায়। আর গাজা?
আজ মার্কিন সাম্রাজ্যের ভেতরে ফাটল স্পষ্ট। ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশ এখন ফিলিস্তিনপন্থী। তরুণ রিপাবলিকানরাও বদলাচ্ছে। এমনকি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠদের ভেতরেও বিরক্তি স্পষ্ট।
নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির প্রগতিশীল বিজয় ছিল এক ভূমিকম্পের মতো। ট্রাম্প নিজেই বাধ্য হলেন যুদ্ধ থামাতে। নেতানিয়াহুকে হুমকি দিলেন: আর নয়।
এই যুদ্ধে ইসরায়েল জিততে পারেনি। আর আমেরিকা ইসরায়েলের সাথে থেকে জিততে পারছে না।
এটা বিজয় নয়—এটা সেই অভিমানী সাম্রাজ্যিক বিভ্রমের পুনরাবৃত্তি, যা বারবার ভেবেছে আগ্রাসন মানেই চিরস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ।
প্রতিবার তারা ঘোষণা করেছে: “এই অঞ্চল আমাদের দখলে।”
প্রতিবার অঞ্চলটি জবাব দিয়েছে: আরও জোরালো, আরও সাহসী, আরও অদম্য হয়ে।