যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিমান হামলা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছে—এমন দাবি থাকলেও প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার: ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি কখনোই বন্ধ করবে না।
২০২৫ সালের জুন মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের ফোর্দো ও নাটাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বিমান হামলার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানায়, ক্ষয়ক্ষতি “মাঝারি থেকে গুরুতর” হতে পারে, যদিও তারা “কম আত্মবিশ্বাসের” কথা স্বীকার করে। অথচ ট্রাম্প দাবি করেন, “এই সাইটগুলো সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।”
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই বলেছেন, “আমাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখব।”
ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেন, “আমরা আগে থেকেই পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের উৎপাদন বা সেবায় কোনো বাধা আসবে না।”
সেটেলাইট চিত্রে নাটাঞ্জ ও ফোর্দোতে ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে। তবে, ইরান দাবি করেছে, হামলার আগেই তারা উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে। DIA-এর প্রতিবেদনে এটিও স্বীকার করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে—যা অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় ৯০% এর কাছাকাছি।
CIA-এর পরিচালক জন র্যাটক্লিফ বলেন, “ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, পুনর্গঠন করতে বছর লেগে যাবে।” তবে DIA এমন দাবি মানতে নারাজ।
২০০৩ সালে ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইস্যুতে DIA ও CIA-এর পরস্পরবিরোধী মূল্যায়নের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তখনও CIA’র তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
এবার ট্রাম্পের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড ট্রাম্পের দাবি সমর্থন করছেন, যদিও মার্চে তিনি বলেছিলেন—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অনুমোদন দেয়নি।
IAEA-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “ধ্বংস হয়েছে বলা অতিরঞ্জন হবে, তবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।”
২০১৫ সালের ইরান পরমাণু চুক্তি (JCPOA)—যা ইরানকে ৩.৭% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছিল—বেশ কার্যকর ছিল, যতক্ষণ না ২০১৮ সালে ট্রাম্প তা প্রত্যাহার করেন। এখন, যদিও তিনি বলেছেন, “পুরনো চুক্তিতে ফিরে যাব না”, তবু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি নতুন নামে পুরনো কাঠামোর চুক্তি আনতে পারেন।
তবে তাতে ইসরায়েলের সম্মতি পাওয়া কঠিন হবে, আর ইরান চাইলে কি শুধুই শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি রাখতে পারবে? সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
IAEA জানিয়েছে, তাদের পরিদর্শকরা এখনো ইরানে আছেন, এবং যে কোনো সময় তদারকির জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল একটি বিল পাস করে UN পর্যবেক্ষকদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “যদি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে, তবে সেটি অস্ত্র তৈরির পথকেই ইঙ্গিত করবে।”
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেন, “ইরান আবার পারমাণবিক স্থাপনা গড়বে না। যদি গড়ার চেষ্টা করে, আমরা আবার হামলা করব।” তিনি NATO সম্মেলনে বলেন, “যদি না আমি কিছু করি, তাহলে অন্য কেউ করবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়েছে কি না—তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে ইরান এর ভবিষ্যৎ ছাড়তে প্রস্তুত নয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিকাঠামো এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও তারা কর্মসূচি বজায় রাখার সংকল্পে অটল। আবারও একটি কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোলা থাকলেও, তা কতটা বাস্তবসম্মত তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ইরান ত্রিমুখী উত্তেজনার ভবিষ্যতের উপর।