মার্কিন নেতৃত্বাধীন আল-উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের হামলার সময় কাতারের প্রধানমন্ত্রী যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনের উপায় নিয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, তখনই তাদের কাছে আসে চাঞ্চল্যকর খবর—ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র কাতারের দিকে ধেয়ে আসছে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, রাজধানী দোহার এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কেঁপে উঠেছিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহতের সময়।
এই হামলা উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ছিল একটি বড় ধাক্কা। তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় রাজ্যগুলো তখন ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধে নিজেদের শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল। সেই যুদ্ধে শেষ দফায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নিউক্লিয়ার স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে।
বাহরাইনে মার্কিন নৌ সদর দপ্তর থাকায় সেদিন জনগণকে প্রধান সড়কে চলাচল না করতে বলা হয়। কুয়েতে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। দুবাই ও আবুধাবিতে অনেকেই আগেভাগেই দেশ ছাড়ার টিকিট কাটেন, কেউ কেউ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ঘরে মজুত রাখেন।
দোহার বাসিন্দারাও সেদিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের আশ্রয় নিতে বলা হয়। মার্কিন সেনাদের আল-উদেইদ ঘাঁটি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
কাতারের উন্নত সামরিক রাডার ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কাতারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তবে নিশ্চিততা আসে মাত্র এক ঘণ্টা আগে।
এক কাতারি সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “শুরুর দিকে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না—তাদের আসল লক্ষ্য কোথায়। কিন্তু এক পর্যায়ে স্পষ্ট হয়ে যায়, আল-উদেইদ ঘাঁটি নিশানায় রয়েছে।”
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হয়, ১৯টি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আল-উদেইদের দিকে আসছে।
সঙ্গে সঙ্গে কাতার তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে। দুইটি সাইট থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। কাতারি সেনাবাহিনীর ৩০০ জন সদস্য এই প্রতিরক্ষা অভিযানে অংশ নেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে, তবে পুরো অভিযানটি ছিল “কাতারি নেতৃত্বাধীন”।
মোট ১৮টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা হয়—৭টি পারস্য উপসাগরের আকাশে, ১১টি দোহার ওপর দিয়ে। মাত্র একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির নির্জন এলাকায় আঘাত হানে, যার ক্ষতি ছিল খুবই সামান্য।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইরান হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম বার্তা দিয়েছিল। তবে কাতার সরাসরি ইরানের কাছ থেকে কোনো সতর্কতা পায়নি।
আল-আনসারি বলেন, “ইরান অনেক আগেই আমাদের জানিয়েছিল—যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভূখণ্ডে হামলা করে, তবে যেসব দেশে মার্কিন ঘাঁটি আছে, সেগুলো বৈধ লক্ষ্য হয়ে যাবে।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এর পুনরুল্লেখ করেছিলেন ইস্তানবুলে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে।
ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ পরে জানায়, “এই হামলায় কাতার বা কাতারি জনগণের জন্য কোনো হুমকি ছিল না।”
তবে, আল-আনসারি জোর দিয়ে বলেন—“আমরা কখনোই আমাদের দেশকে রাজনৈতিক খেলার অংশ বানিয়ে আক্রমণের সুযোগ দিই না। এটা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা।”
হামলার কিছু সময় পরই ট্রাম্প ফোন করেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে। তিনি জানান, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী এবং কাতারের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গেও এই প্রস্তাব দিতে চান।
আল-আনসারি বলেন, “ঠিক যখন আমরা প্রতিশোধ নেব কি না ভাবছি, তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফোন আসে—একটি শান্তি উদ্যোগের দরজা খুলছে।”
এরপর কাতার দ্রুত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামে। কাতারের মুখ্য আলোচক মোহাম্মদ বিন আব্দুলআজিজ আল-খুলাইফি ইরানিদের সঙ্গে কথা বলেন, আর প্রধানমন্ত্রী আল থানি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
“আমরা খুব অল্প সময়েই একটি চুক্তি নিশ্চিত করতে পারি,” বলেন আল-আনসারি।
“সেদিন রাতে সব কিছুই সম্ভব ছিল—আমরা চাইলেই প্রতিশোধ নিতে পারতাম, অথবা সব পথ বন্ধ করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, এই মুহূর্তটা শান্তির সূচনা করতে পারে।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে।