—রয়টার্সের অনুসন্ধান
ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল নতুন মাত্রা পেয়েছে- এবার তাদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোরেরা। পোল্যান্ডে আটক এক কানাডিয়ান কিশোরের মামলায় সেই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে অপ্রশিক্ষিত তরুণদের ব্যবহার করে মস্কো ইউরোপজুড়ে নাশকতা ও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। আর অর্থ জোগানে ব্যবহার হচ্ছে বিটকয়েন ও অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি।
২০২৪ সালের মে মাসে কোপেনহেগেনে অবস্থানকালীন আর্থিক টানাপোড়েনে পড়েন কানাডার ১৭ বছর বয়সী লেকেন পাভান। তখন তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি (FSB)-এর হ্যান্ডলারের কাছে বার্তা পাঠান: “তুমি কি আজ বিটিসি পাঠাতে পারো?“।
‘স্লোন’ ছদ্মনামের সেই রুশ কর্মকর্তা তাকে ডোনেটস্ক থেকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এরপর পাভান পোল্যান্ডের ওয়ারশতে যান কারণ সেখানেই বিটকয়েন সহজে নগদে রূপান্তর করা যেত। কিছুদিন পর মদ্যপ অবস্থায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তিনি নিজেই হোটেলের রিসেপশন থেকে পুলিশ ডেকে স্বীকার করেন, তিনি এফএসবির হয়ে কাজ করছেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া পাভান ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দোষ স্বীকার করেন এবং ২০ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার অপরাধে সাধারণত ৫ বছরের শাস্তি হলেও- অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ও তদন্তে সহযোগিতা করায় তাকে ন্যূনতম সাজা দেওয়া হয়েছে।
রয়টার্সের অনুসন্ধান অনুসারে, পোলিশ আদালতের ১,৪০০ পৃষ্ঠার তদন্ত নথি ও পাভানের মোবাইল থেকে উদ্ধার হওয়া ৩০০-্এর বেশি বার্তা পর্যালোচনা করে জানা যায়, কিশোরদের হালকা প্রণোদনা ও ভয় দেখিয়ে নিয়োগ দিয়ে এফএসবি ইউরোপে গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।
পাভানের বিটকয়েন ওয়ালেটে টাকা পাঠানোর সূত্র ধরে ব্লকচেইন বিশ্লেষকদের সহায়তায় বিশাল একটি ক্রিপ্টো ট্রান্সফার চেইন শনাক্ত করা হয়, যা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রক্রিয়াজাত করেছে ২০২২ সালের জুন থেকে। সেই একই ওয়ালেট থেকে পাভানের বিটকয়েনও পাঠানো হয়েছিল।
রাশিয়ার এই বিকল্প অর্থ জোগানের পথ ইউরোপীয় গোয়েন্দাদের জন্য নতুন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এতে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থেকে অর্থ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে।
রাশিয়ার কূটনীতিকদের ইউরোপ থেকে বহিষ্কারের পর থেকে অভিজ্ঞ এজেন্টের সংকট তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁক পূরণে রাশিয়া অল্পবয়সী, সহজলভ্য এবং অর্থকষ্টে থাকা তরুণদের বেছে নিচ্ছে। ন্যাটোর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ, সহজে প্রলুব্ধ হয় এবং কম খরচে নিয়োগ দেওয়া যায়।”
পাভানও বলেন, তার রাশিয়া ভ্রমণের ব্যয় কে বহন করছে- তা জানতে চেয়েছিলেন তার মা। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই ভ্রমণের পেছনে ছিল রাশিয়ার একটি সুপরিকল্পিত মিশন।
ন্যাটো ও ইউরোপীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, রাশিয়ার এই হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল শুধুমাত্র সামরিক নয়, এটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, বিভ্রান্তি তৈরি এবং ইউক্রেন-সমর্থন হ্রাসে সহায়ক। ইউক্রেন ও মিত্র দেশগুলোর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করাই এর লক্ষ্য।
রাশিয়া যদিও এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়- এই সবই “পশ্চিমা অপপ্রচারের অংশ”। তবে পোল্যান্ড, জার্মানি, লিথুয়ানিয়া, এমনকি ব্রিটেনেও রাশিয়া-সংশ্লিষ্ট নাশকতায় জড়িত কমপক্ষে ১২ কিশোরকে গ্রেপ্তারের তথ্য সামনে এসেছে।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি করা হয়েছে যে, ইউক্রেনও রাশিয়ার অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার জন্য কিশোরদের নিয়োগ দিচ্ছে। তবে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।