অবশেষে দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। আপাতত বন্দুক থেমেছে, কিন্তু থামেনি রাজনীতি। এখন আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা বিশ্লেষণমূলক প্রস্তাব, যেটিকে তিনি গাজা পুনর্গঠন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শান্তির পরিকল্পনা নয়, বরং এক নতুন দখলদার কাঠামোর সূচনা।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনা করবে ফিলিস্তিনি কমিটি, কিন্তু প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে ‘বোর্ড অব পিস’ নামের একটি কর্তৃপক্ষ। এই বোর্ডের নেতৃত্বে থাকবেন ট্রাম্প নিজে এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। অর্থাৎ গাজা কার্যত চলে যাবে পশ্চিমা তত্ত্বাবধানে।
কিন্তু হামাসসহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সব সংগঠন একযোগে জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো বিদেশি শাসন মেনে নেবে না। তাদের মতে, এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক অবস্থান-
এই বিতর্কিত পরিকল্পনাকে ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা ও বিশ্লেষকরা মতামত দিয়েছেন। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সাংবাদিক ইজাজ হায়দার ‘ডন’-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ট্রাম্পের পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হবে তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উদ্ধৃতি টেনে দেখিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রকৃত অবস্থান আসলে কী।
সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আমেরিকার অন্যতম ঐতিহাসিক ভুল হলো নিজেদের ‘নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে দাবি করা। ট্রাম্প অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে, আমেরিকা ইসরাইলের পাশে আছে।”
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, “ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ হারিয়েছে। এখন তাদের আলোচনায় ফিরতে হবে, না হলে চুপ থাকতে হবে।”
অন্যদিকে বাহরাইনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ আল খলিফা স্বীকার করেছেন, “বাহরাইন ও ইসরাইলের মধ্যে গোয়েন্দা সহযোগিতা চলছে, এবং মোসাদ এখানেও সক্রিয় থাকবে।”
এমন বাস্তবতায় স্পষ্ট যে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নয়, বরং ইসরাইলকেন্দ্রিক নিরাপত্তা জোটের স্বার্থ রক্ষার একটি রাজনৈতিক প্রকল্প।
কায়রো বৈঠক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি-
এ সময় গাজা বিষয়ক আলোচনায় নতুন গতি এসেছে কায়রো সম্মেলনের মাধ্যমে। মিশরের পর্যটন নগরী শারম আল-শেখে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। সম্মেলনে অংশ নিয়েছে ২০টিরও বেশি দেশ।
মিশরের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ঘোষণায় বলা হয়, এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য হলো গাজায় যুদ্ধের অবসান, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। এতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারসহ ইউরোপীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অংশ নেবেন কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
অন্যদিকে হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা এই সম্মেলনে থাকবে না। তাদের বক্তব্য, “আমরা কাতার ও মিশরের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছি, তবে বিদেশি কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”
শান্তির নামে দখলদার কাঠামো-
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার মূল কাঠামো দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। এক, এটি একটি প্রশাসনিক নথি হিসেবে; দুই, মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ উপনিবেশিক ইতিহাসের আলোকে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইতিহাসের প্রেক্ষাপট না বুঝে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ফল হবে উল্টো। কারণ এটি শান্তি নয়, অস্থিতিশীলতাই ডেকে আনবে।
প্রথমত, এটি প্রকৃত অর্থে কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়, বরং এক তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির কৌশল। এতে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব হরণ করে ‘বর্ণবৈষম্যমূলক প্রশাসন’ বৈধ করার প্রয়াস চলছে।
পরিকল্পনার কাঠামোগত ফাঁকফোকর-
দলিলটি আশ্চর্যজনকভাবে অস্পষ্ট। কোথায়, কবে এবং কীভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে—এর কোনো সময়সীমা নেই। “বোর্ড অব পিস” ট্রাম্পের অধীনে চলবে, না জাতিসংঘের? প্রশ্ন রয়ে গেছে।
জাতিসংঘ ইতিমধ্যে গাজায় ইসরাইলি হামলাকে গণহত্যা ঘোষণা করেছে—যা ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকার করেনি। ফলে ‘আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ কার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে—এ নিয়েও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে।
আরও বড় উদ্বেগ হলো, ইসরাইল নিজে ঠিক করবে যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণ হয়েছে কি না। অর্থাৎ, যুদ্ধ থামানো বা পুনরায় শুরু করা সম্পূর্ণ তাদের হাতে।
গাজার ভেতরে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার না করে সেখানে “আন্তর্জাতিক বাহিনী” রাখার প্রস্তাব বাস্তবে এক দখলদারিত্বকে অন্য দখলদারিত্বে বদলানোর নামান্তর। আর গালফ দেশগুলোকে এই বাহিনীর অর্থায়নের দায়িত্ব দিয়ে ইসরাইলকে দায়মুক্ত করা হয়েছে।
অমীমাংসিত প্রশ্ন ও পুনর্গঠনের বাস্তবতা-
দলিল অনুযায়ী রাফাহ সীমান্ত ও ফিলাডেলফি করিডোরের নিয়ন্ত্রণও ইসরাইলের হাতে থাকবে। এতে গাজার প্রবেশদ্বারগুলো কার্যত দখলকৃতই থাকবে।
“আন্তধর্মীয় সংলাপ” নামের যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা-ও অস্পষ্ট—কোন মানদণ্ডে মনোভাব পরিবর্তন মাপা হবে, তা নির্ধারিত নয়।
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে দৈনিক ১০০ ট্রাক কাজ করলেও সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ বছর। এমন বাস্তবতায় পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি অবাস্তবই রয়ে যায়।
ইতিহাসের ভুল পাঠ ও প্রথম মেয়াদের শিক্ষা-
ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় ভুল হলো, তিনি ইতিহাসকে উল্টোভাবে বুঝেছেন। ইসরাইলের মূল প্রকল্প যে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও নির্মূল করা—তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি।
২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য নীতির দায়িত্ব দেন তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে—ডেভিড ফ্রিডম্যান, জেসন গ্রিনব্লাট ও জামাতা জ্যারেড কুশনারকে। এরা সবাই কট্টর জায়নিস্ট, যারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ধারণা মানে না।
এই দলের হাত ধরেই আসে তথাকথিত ‘আব্রাহাম চুক্তি’। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। আরব দেশগুলোকে পাশে টেনে ফিলিস্তিনকে একঘরে করার এই নীতি ট্রাম্প প্রশাসন ‘শান্তি’ বলে প্রচার করেছিল।
কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টো—ইসরাইলি আগ্রাসন বেড়েছে, এবং সেখান থেকেই ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের পাল্টা আক্রমণের মঞ্চ তৈরি হয়।
বর্তমান বাস্তবতা ও নতুন অচলাবস্থা-
২০২৫ সালের অক্টোবরে কায়রো আলোচনায় হামাস বন্দি বিনিময় ও আংশিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও ট্রাম্পের পুরো ২০ দফা পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, গাজার প্রশাসন চালাবে ফিলিস্তিনি ঐকমত্যভিত্তিক প্রযুক্তিবিদ সরকার, পশ্চিমা তত্ত্বাবধানে নয়।
হামাস নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, শুধু জানিয়েছে—“ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
অন্যদিকে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক টিকে থাকার জন্য এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছেন, যেহেতু জনমতে তার জনপ্রিয়তা তলানিতে।
কেন এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে-
ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো স্পষ্ট—
১. এটি ইতিহাসবিহীন ও বাস্তবতাবর্জিত;
২. যুদ্ধ ও সামাজিক মনোভাবের প্রকৃতি উপেক্ষিত;
৩. ইসরাইলের সংসদ নিজেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ধারণাকে ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ বলেছে;
৪. গাজার প্রতি ইসরাইলি নীতি শান্তির নয়, বরং জাতিগত নির্মূলের কৌশল;
৫. পরিকল্পনার কাঠামো একতরফা ও উপনিবেশিক মনোভাবসম্পন্ন।
বিশ্লেষক নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইনের ভাষায়, “গণহত্যার ভেতরে কোনো আলোকরেখা থাকে না।”
অতএব, ট্রাম্পের এই তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা কেবল সাময়িক বিরতির সুযোগ তৈরি করবে, কিন্তু স্থায়ী শান্তি নয়। যতদিন আরব রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, ততদিন ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা অধরাই থেকে যাবে।
সূত্র: ডন, জাতিসংঘ, খামা প্রেস, কায়রো প্রেস স্টেটমেন্ট

