লেখক: স্তেফান ওলফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের একজন অধ্যাপক।
যুদ্ধ চলছে, প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। তারমধ্যেই গোলাবারুদ ও অস্ত্রের সংকট। ইউক্রেন সামরিক সহায়তার জন্য যখন দিশেহারা, তখন ইউরোপের মিত্ররা সহায়তার হাত কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। যদিও রাশিয়ার অগ্রযাত্রা রুখতে তা যথেষ্ট নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা আমেরিকার মতো বড় পরিসরে অস্ত্র উৎপাদন করে কিয়েভকে দেওয়ার মতোন অবস্থায় নেই। এমন প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের জন্য ৬১ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার প্রস্তাব সম্প্রতি পাস হয়েছে আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রেসে। তবে এই প্রস্তাব পাসে দীর্ঘ কয়েক মাস সময় লেগেছে কংগ্রেসের।
এর আগে বেশ কয়েকবার পেছায় এই প্রস্তাব উত্থাপন। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভাজনেরই পরিণাম এসব ঘটনা।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউসে পাস হলেও– এবার বিলটিতে দরকার উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদন। কেবল তারপরেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এতে সই করে আইনে পরিণত করতে পারবেন।
সিনেটে খুব বেশি বাধার আশঙ্কা নেই। ইতঃপূর্বেও একই ধরনের একটি সহায়তা প্যাকেজে অনুমোদন দিয়েছিল সিনেট। আর বাইডেন শুরু থেকেই ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে সোচ্চার। ফলে বাকি ধাপগুলো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতাই বলা যায়।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই সহায়তা কি নিশ্চিত হারের মুখ থেকে ইউক্রেনকে রক্ষা করবে? প্রশ্নটি যেমন সরল নয়, তেমনি উত্তরও সোজাসাপ্টা দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন যখন যুদ্ধ সরঞ্জামের সংকটে – তখন বেশকিছু এলাকায় নতুন করে ভূমির দখল নিয়েছে রুশ সেনারা। তাই মার্কিন সহায়তা প্যাকেজ যে রাশিয়ার দৃঢ় অগ্রগতিকে থামিয়ে – ইউক্রেনের জন্য কিছুটা দম ফেলার সুযোগ তৈরি করবে– তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সিনেট ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পর এসব সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়ে কিছু সরবরাহ-ব্যবস্থার সমস্যাও কাটিয়ে উঠতে হবে। এই মুহূর্তে ইউক্রেনের সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে যে যুদ্ধ সরঞ্জাম দরকার, তা হলো গোলাবারুদ। এগুলো বিপুল পরিমাণে প্রতিবেশী পোল্যান্ডেই মজুত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, এখন তা নিরাপদ মজুত থেকে বের করে পৌঁছে দিতে হবে লড়াইয়ের সম্মুখভাগ পর্যন্ত।
এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনাদের সেই অনুযায়ী রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ ও তার প্রয়োগ করতে হবে।
গোলাবারুদের সংকটে গত মাস কয়েক ধরে রেশন করে গোলা ব্যবহার করতে হয়েছে ইউক্রেনকে। এই অবস্থায়, দেশটির রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব অচিরেই বিপুল গোলাবারুদ আসছে এই বার্তা এরমধ্যেই পেয়ে গেছেন। ফলে কিয়েভকে এখন আগের মতো কৃচ্ছ্রসাধন করে গোলা ছুঁড়তে হবে না।
প্রতিরক্ষামূলক কৌশল বা রক্ষণাত্মক লড়াইয়ে এতে তাদের সেনারা ভালো সুবিধা পাবে। বরং এগোতে গেলেই বড় ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে রুশ প্রতিপক্ষের। এতে ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবলও চাঙ্গা হবে। বর্তমানে তারা যেভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েছে– সেই পরিস্থিতি কিছুটা কাটবে বলেও ধারণা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পোঁছানোর আগেও এটা হতে পারে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা
ক্ষণিকের স্বস্তির বাইরে মার্কিন অস্ত্র সহায়তার এই প্যাকেজ কি আরো বেশিকিছু দিতে পারবে? এটাও নির্ভর করবে বেশকিছু বিষয়ের ওপর। কারণ টেকসইভাবে সামরিক ও অন্যান্য প্রকার ত্রাণ সহায়তা দেওয়া– কেবল দাতারাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়ই নয়। সর্বাগ্রে এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়।
আসছে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জরুরি এই সহায়তা পাসে কংগ্রেস যে দীর্ঘসময় নিয়েছে– তা নির্বাচনের বছরে প্রধান দুই দলের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।
ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তার প্রস্তাব আনা হলে তার বিরুদ্ধে ভোট দেবেন বলে জানান প্রতিনিধি পরিষদের বেশিরভাগ রিপাবলিকান সদস্য। অথচ হাউসে তারাই হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। একারণেই গত কয়েক মাস ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থিত রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন প্রস্তাবটিতে তাঁর দলের সমর্থনের বিষয়ে মিশ্র বার্তা দিয়ে আসছিলেন।
তবে ইসরায়েলের প্রতি রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতাদের আছে নিশ্চল সমর্থন। তাই ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকেও যুক্ত করা হয়।
শনিবার পাস হওয়া বিলটিতে ইউক্রেনের পাশাপাশি ইসরায়েলকে ২৬ দশমিক ৪ ডলারের সামরিক সহায়তা এবং গাজায় ৯.১ বিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তার জন্য নির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ করা হয়।
তাতে আপাত অচলাবস্থা কেটেছে মনে হলেও– নভেম্বরের নির্বাচনে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে হোয়াইট হাউসে ফেরেন– তাহলেই কপাল পুড়বে কিয়েভের। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির ওপর ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে। একারণেই ট্রাম্প সমর্থক রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা এতদিন বিলটির বিরোধিতা করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের ভালো চান না– সম্প্রতি এমন মন্তব্যই করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমসারির গণমাধ্যম পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে।
বিপরীতে, ভ্লাদিমির পুতিনের বিষয়ে ইতিবাচক ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়েই পুতিনের সাথে তাঁর সখ্যতা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় মার্কিন গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারক মহলে। ওভাল অফিসে ফিরে ট্রাম্প পুতিনের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেবেন এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
এর আগে ইউক্রেনের জন্য সহায়তার প্যাকেজ পাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও সমস্যা হয়েছে। ২৭ সদস্যের ইইউয়ের মাত্র একটি দেশের সরকারপ্রধান হাঙ্গেরির ভিকটর ওরবান রাশিয়াপন্থী হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরোধিতার কারণেই সমস্যা দেখা যায়। পরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এ বিরোধের সমাধানও হয়। কিন্তু, এখন স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো ওরবানের সমমনা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছেন। তিনিও ইউক্রেনকে আরো সহায়তা দেওয়ার বিরোধী। কিয়েভকে রাশিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধাবসানের পরামর্শ দিয়েছেন ফিকো।
আগামী জুনেই হতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন। এই নির্বাচনে ইউক্রেনকে অবাধ সহায়তা দেওয়ার বিরোধী রুশপন্থী সদস্যদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ইইউয়ের তহবিল বরাদ্দের সিদ্ধান্তে তাঁদের প্রভাব সীমিত হলেও– এই সদস্যরা কিয়েভের ইইউ সদস্যপদ লাভের আলোচনায় বড় ঝামেলা সৃষ্টি করবেন।
অর্থনৈতিক সামর্থ্য
নজিরবিহীন মাত্রায় সমরাস্ত্র উৎপাদন করছে রাশিয়া। প্রবেশ করেছে যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে। এতে যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদনকে দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। জোরালো হয়েছে মস্কোর প্রতিরক্ষা শিল্প কমপ্লেক্স। সে তুলনায়, সামরিক শিল্পের উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। তাছাড়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে বিপুল সমরাস্ত্র কিনছে রাশিয়া। যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে পাচ্ছে চীনের সমর্থন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই অবস্থায় প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ করছে। ইউক্রেনও রয়েছে এই উদ্যোগে। ফলে ২০২৫ সালেই তাদের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়া বর্তমান হারে সমরাস্ত্র উৎপাদন কতদিন ধরে চালিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয়ের জায়গা আছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীন ও ইরানকে মস্কোর থেকে দূরে থাকতে রাজি করাতে পারে– কেবল তাহলেই এটা সম্ভব। যা ঘটার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
অতি-আশাবাদী হয়ে ধরে নেওয়া যাক রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়লো, তবুও শক্তির ভারসাম্যের রাতারাতি কোনো মোড় পরিবর্তনের আশা নেই। চলতি বছরে পশ্চিমা দেশগুলো সবাই মিলে মোট যে সমরাস্ত্র উৎপাদন করবে তাতেও ইউক্রেনের যুদ্ধজয় নিশ্চিত হবে না।
আপাতত যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে রাশিয়াই
শত্রু যখন বিপাকে, তখন প্রতিপক্ষের থাকে সুবিধেমতো আগেভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কৌশলগত এই ইনিশিয়েটিভ বা উদ্যোগ নেওয়ার সুবিধাজনক অবস্থায় এখন রাশিয়া। জনবলেও বর্তমানে মস্কো এগিয়ে আছে। ইউক্রেনের দুর্বল হয়ে পড়া আকাশ প্রতিরক্ষার কারণে আকাশপথে আধিপত্য করছে রুশ যুদ্ধবিমান। সব মিলিয়ে রাশিয়া এখন তার আক্রমণ অভিযানগুলো দ্বিগুণ গতিতে চালাতে পারছে।
ইউক্রেন তার মিত্রদের থেকে নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য সমরাস্ত্র পাওয়ার আগেই– বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে রাশিয়া।
তাছাড়া, শুধুমাত্র ইউক্রেনই পশ্চিমা দুনিয়ার একমাত্র নিরাপত্তা সংকট নয়। ইসরায়েল ও তাইওয়ানকে নিয়েও সার্বিক পশ্চিমকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। ইউক্রেন ও ইসরায়েলকে দেওয়া সামরিক সহায়তার প্যাকেজে তাইওয়ানও ছিল। সবমিলিয়ে এই প্যাকেজের মূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার। যখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের স্থিতি ৩৪ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে – প্রতি ১০০ দিনে যা এক লাখ কোটি ডলার করে বাড়ছে – সেখানে দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের বিপুল সহায়তা এই তিন মিত্রকেই দেওয়া সম্ভব না। তার সঙ্গে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
আমেরিকার সমর্থনে এক বছরের মধ্যেই রাশিয়াকে হারাতে পারবে ইউক্রেন– মার্কিন নীতিনির্ধারক মহল এমনটাই আশা করছেন। কিন্তু, আলোচিত ঘটনাগুলো মেলালে বোঝা যায়, এই ধারণা নিতান্ত অতি-আশাবাদী এবং মারাত্মক বিভ্রান্তিকর।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সহায়তা আসার পরে কিছুটা শক্তি ফিরবে ইউক্রেনের। এই সুযোগে কিয়েভের উচিত শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া। যুদ্ধবন্ধের এটাই বাস্তবিক সমাধান। কারণ তখন মস্কোও আরো ক্ষতি এড়াতেই সংলাপে যেতে পারে।
কিন্তু, মস্কো ও কিয়েভ যেভাবে আপোষহীন বিজয় অর্জনের বক্তব্য দিয়েছে তাতে এই চিন্তাও হয়তো অতি-আশাবাদী। ফলে আরেকটি অন্তহীন সংঘাত হিসেবেই হয়তো টিকে যাবে ইউক্রেন যুদ্ধ।