গ্রিক মিথলজির সেভেন সিস্টার্স শব্দযুগল যখন টাইটান আটলাসের সাত কন্যাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, তার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ছিল ভিন্ন। তবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে ভারতের প্রেক্ষাপটে, সেভেন সিস্টার্স শব্দটি প্রথম পরিচিতি পায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে কেন্দ্র করে। এই শব্দের ব্যবহার ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময়ে প্রসার লাভ করে। যদিও এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রাসঙ্গিক ছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে “সেভেন সিস্টার্স” বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি প্রথমে বোঝাতো সাতটি গুরুত্বপূর্ণ নারী কলেজকে, যেখানে নারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান করা হতো।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে “সেভেন সিস্টার্স” মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সাতটি সুইং স্টেটকে নির্দেশ করে। এই সাত রাজ্য হলো: জর্জিয়া, মিশিগান, অ্যারিজোনা, উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়া, নেভাডা এবং নর্থ ক্যারোলাইনা। এদেরকে বলা হয় “সুইং স্টেট” কারণ, এ রাজ্যগুলোতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীদের মধ্যে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, এবং প্রতিবার নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তনশীল থাকে। এ কারণেই এ রাজ্যগুলোর ফলাফল নির্ধারণ করে হোয়াইট হাউসের পরবর্তী বাসিন্দা।
জর্জিয়ার নির্বাচনী প্রেক্ষাপট সবসময়ই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য আকর্ষণীয়। ১৯৯২ সালে বিল ক্লিনটন রাজ্যে ডেমোক্র্যাটিক বিজয়ের পথ দেখান, কিন্তু পরবর্তী ছয়টি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীরা রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন মাত্র ১১,৭৭৯ ভোটের ব্যবধানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে নতুন এক অধ্যায় রচনা করেন। জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটের অংশগ্রহণ এবং তরুণ ও নারীদের মধ্যে ডেমোক্র্যাটিক সমর্থন বাড়ায়, রাজ্যটি একটি শক্তিশালী সুইং স্টেটে পরিণত হয়েছে।
জনমিতি বিশ্লেষণ বলছে, জর্জিয়ার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা আফ্রিকান-আমেরিকান, যা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য একটি বড় ভিত্তি। পাশাপাশি এশীয় জনসংখ্যাও ৫ শতাংশের কাছাকাছি। এই পরিবর্তিত জনমিতি ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীদের জন্য আশাব্যঞ্জক হলেও, সর্বশেষ জরিপগুলোতে ট্রাম্পও শক্ত অবস্থানে আছেন। এমারসন এবং পোলারার জরিপে তিনি ১ পয়েন্টে এগিয়ে, অন্যদিকে মারিস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস/সারিনা কলেজের জরিপে কমলা হ্যারিস এগিয়ে আছেন ৪ পয়েন্টে।
মিশিগান রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী মানচিত্রে একটি প্রধান রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৯২ সাল থেকে ৭টি নির্বাচনের মধ্যে ৬টিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এখানে বিজয়ী হলেও, ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের পরাজয় অনেককে হতবাক করেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে জো বাইডেন এখানে পুনরায় ডেমোক্র্যাটিক বিজয় নিশ্চিত করেন। তবে এবার মিশিগানের আরব-আমেরিকান ভোটাররা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠেছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা নিয়ে তাদের ক্ষোভ বাড়ছে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এখানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
মিশিগানের ১৫টি ইলেকটোরাল ভোটকে লক্ষ্য করে উভয় দলের প্রার্থীরাই বারবার রাজ্যটিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমারসন এবং পোলারার জরিপে দেখা গেছে, দুই প্রার্থী এখানে সমানভাবে প্রতিযোগিতায় আছেন, যেখানে মারিস্টের জরিপে ৫ শতাংশ ব্যবধানে কমলা হ্যারিস এগিয়ে আছেন।
অ্যারিজোনা রাজ্যের জনমিতি সম্প্রতি ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে রাজনৈতিক সমীকরণে। এখানকার ১১টি ইলেকটোরাল ভোট নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি সাধারণত শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও, হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। হিস্পানিকরা এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়াও, আফ্রিকান-আমেরিকান এবং রেড ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীও এখানে উল্লেখযোগ্য।
তবে অভিবাসন ইস্যুতে অ্যারিজোনা সবসময়ই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবৈধ অভিবাসন নিয়ে কঠোর অবস্থান তাঁকে এখানকার অনেক ভোটারের সমর্থন দিয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাটদের জন্য জনমিতির পরিবর্তন একটি ইতিবাচক বিষয়। জরিপ অনুযায়ী, এমারসন এবং পোলারার জরিপে দুই প্রার্থী সমানে সমান অবস্থানে রয়েছেন, তবে নিউইয়র্ক টাইমসের জরিপে ট্রাম্প ৫ শতাংশে এগিয়ে আছেন।
উইসকনসিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে। গত ছয়টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটিতে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। তবে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে একবার উইসকনসিন জয় করেছিলেন, সেই সফলতাই তাঁকে আবারও এই রাজ্যে প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।
উইসকনসিনে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ শ্বেতাঙ্গ, এবং রিপাবলিকানদের জন্য এখানকার এই শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা বরাবরই একটি নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে কাজ করেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন বাড়তে দেখা গেছে, যদিও প্রতিবারই এই জয় এসেছে খুব সামান্য ব্যবধানে। কেবল বারাক ওবামা দু’বারই এই রাজ্যে বড় ব্যবধানে জিতেছেন। উইসকনসিনের ১০টি ইলেকটোরাল ভোটের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার কঠোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। এবারের রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনও হয়েছে উইসকনসিনে, যেখানে ট্রাম্প দলের মনোনয়নও গ্রহণ করেছেন।
জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, উইসকনসিনে কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে খুবই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। মারিস্ট ও কুইনিপিকের জরিপ অনুযায়ী হ্যারিস ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও এমারসন/পোলারার জরিপে সমতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, এই রাজ্যে যে কারো পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব।
পেনসিলভানিয়া, একসময় রিপাবলিকানদের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এটি ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে ঝুঁকছে। আশির দশকে নিয়মিতভাবে রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট পড়লেও, পরের দুই যুগে এটি ডেমোক্র্যাটদের পাশে ছিল। তবে সর্বশেষ দুই নির্বাচনে পেনসিলভানিয়া জয়ী হয়েছে ভিন্ন দলের প্রার্থীরা, যা একে আবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটে পরিণত করেছে।
এই রাজ্যে দুই দলের প্রার্থীদের জন্য প্রচারণা বেশ তীব্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিস, উভয়েই এই রাজ্যে বারবার আসছেন এবং ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছেন। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ও ইউগভের জরিপ অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস এখানে ৪৮ শতাংশ সমর্থন পাচ্ছেন, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে আছে ৪৬ শতাংশ ভোটার। তবে কুইনিপিক ইউনিভার্সিটির জরিপ অনুযায়ী, হ্যারিস ৬ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। এইসব ফলাফল দেখে বোঝা যায়, পেনসিলভানিয়ায় এবারের নির্বাচনে জয় নির্ধারণ হবে অত্যন্ত কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে।
দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্য নেভাডা, যার ৬টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে, সুইং স্টেট হিসেবেও পরিচিত। নেভাডার গভর্নর একজন রিপাবলিকান হলেও দুই সিনেটর ডেমোক্র্যাট। গত ১২টি নির্বাচনে এখানে দুই দল সমান সংখ্যক বার জয়লাভ করেছে। নেভাডার বিশেষত্ব হলো, এখানকার ভোটারদের মধ্যে ৪০ শতাংশ কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন, অর্থাৎ তারা নিরপেক্ষ।
নির্বাচনে নেভাডার ভোটারদের সিদ্ধান্ত গর্ভপাত, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের মতো ইস্যুগুলোর উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হতে পারে। নেভাডার জরিপগুলোও এখানে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমারসন/পোলারার এবং সিএনএন/এসএসআরএসের জরিপ অনুযায়ী, দুই প্রার্থী সমান অবস্থানে আছেন।
নর্থ ক্যারোলাইনা, ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিকানদের ঘাঁটি হলেও, সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বারাক ওবামা ২০০৮ সালে একমাত্র ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে এখানে জয়ী হয়েছিলেন। তবে তার পরবর্তী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করেছেন, যদিও তা মাত্র ৭৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে।
নর্থ ক্যারোলাইনায় ২২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান এবং ১০ শতাংশের বেশি হিস্পানিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। এই রাজ্যের মোট ভোটারের ৩৬ শতাংশ কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এবং ৫১ শতাংশ ভোটার নারী, যা ডেমোক্র্যাটদের আশাবাদী করছে। জরিপগুলোতেও দেখা যাচ্ছে, নর্থ ক্যারোলাইনায় ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান প্রার্থীরা প্রায় সমানে সমান অবস্থানে রয়েছেন। এমারসন/পোলারার এবং মারিস্টের জরিপে দুই প্রার্থী সমান অবস্থানে আছেন। তবে নিউইয়র্ক টাইমস/সারিনা কলেজের জরিপে কমলা হ্যারিস ২ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন, যেখানে এমারসন জরিপে তাঁর ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত নির্ধারিত হবে এই সাতটি সুইং স্টেটের মাধ্যমে। প্রতিটি রাজ্যের ফলাফলই হতে পারে নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণকারী। জরিপের ফলাফলগুলোতে প্রতিটি রাজ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে, যা এই রাজ্যগুলোকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, উভয়েই তাদের নির্বাচনী প্রচারণা এসব রাজ্যে কেন্দ্রীভূত করছেন এবং প্রতিটি ভোটই তাদের জন্য মূল্যবান হয়ে উঠেছে।
সুইং স্টেটগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বাড়ছে। প্রতিটি নির্বাচনে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে, ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচন নিয়ে কেবল মার্কিন জনগণ নয়, সারা বিশ্ব অপেক্ষায় আছে।