পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা নানান খামখেয়ালি প্রকল্পে যথাযথ ‘সম্ভাব্যতা যাচাই’ ছাড়া ‘সরবরাহ ঋণ’ নেওয়ার কারণে বাংলাদেশ অতি দ্রুত ‘ঋণের সাগরে নিমজ্জমান দেশের কাতারে’ প্রবেশ করেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১.১৭ বিলিয়ন ডলার। তখন বিদেশি ঋণ ছিল জিডিপির ১৫.৫ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৭ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চ হারে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৯–এ ছাড়িয়ে যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৯। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও এরপর দ্রুত বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে এবং পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ ১২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়।
খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে হাসিনার ইচ্ছেমতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দিয়েছিল। ২০২৫ সাল থেকে এই খামখেয়ালিপনার খেসারত হিসেবে ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২.৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এ রকম উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হচ্ছে, তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে বাংলাদেশের শাসক মহল সব সময় নিতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু হাসিনা সরকারের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই ছিল ‘সরবরাহ ঋণ’। সরবরাহ ঋণের অসুবিধা হলো, জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সরবরাহ ঋণের সুদের হারও বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সরবরাহ ঋণে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সে জন্য সরবরাহ ঋণকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে ব্যবহৃত কৌশল বলা হয়।
হাসিনার আমলে বাংলাদেশে সরবরাহ ঋণ শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে গিয়েছিল। কারণ, এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন আওয়ামী লীগের নেতা ও হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে লোভনীয় ধান্দায় পরিণত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্তগুলো পরিপালনে শাসকেরা জটিলতার সম্মুখীন হন, তাই বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে সাবেক সরকার প্রধানত সাপ্লায়ার্স ঋণের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছিল। বিশেষত, হাসিনা সরকারের শেষের সাত থেকে আট বছর বেলাগামভাবে অনেকগুলো অত্যন্ত বাজে প্রকল্পে ঋণ গ্রহণে হাসিনার দৃষ্টিকটু আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছিল। এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠনই যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সেটা আন্দাজ করা যায়।
চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সরবরাহ ঋণ দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করছে, তাই চীনের কাছ থেকে সরবরাহ ঋণ পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে মোট ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত ১১ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে ঋণ নিয়ে মোট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। চীনা ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প এ দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন, সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সরবরাহ ঋণে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন, সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু ও চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড।
ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে বাজে প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ ‘সরবরাহ ঋণ প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটির কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এই দুটি ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া, বাকি দেড় শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করছে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে।
অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হলো কেন?
দেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছিল, যে জন্য দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার হাসিনার শাসনামলে দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল। সংখ্যায় দেশ থেকে পুঁজি পাচারকারী হয়তো কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশি সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চ বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে ছিল তাঁদের বেশির ভাগের অবস্থান।
তাদের বেশির ভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘মিল’ হলো, তারা ‘কালোটাকার মালিক’, ভালো মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্পকারখানা–ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তারা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করেছে। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে কালোটাকার মালিক হয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাইয়ে অর্থ পাচার করেছে। কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া ও মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানিয়েছে।
● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক (প্রথম আলো)