যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ৩০ দিন পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর শাসনব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল এনেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যেখানে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারী কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই চাকরি হারিয়েছেন। যদিও প্রশাসন এটিকে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো হ্রাস ও ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ বলে ব্যাখ্যা করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত ট্রাম্পের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিতের কৌশল।
প্রথম পদক্ষেপ: বিরোধীদের দমন-
নির্বাচনের আগেই ট্রাম্প তাঁর নীতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের সঙ্গে জড়িত ফেডারেল তদন্তকারী সংস্থা ও আইনজীবীদের বরখাস্ত করেন। এছাড়া তাঁর আদেশে সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার ও ফেডারেল প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হন।
ট্রাম্পের অভিযোগ, বাইডেন প্রশাসন বিচার বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস) ও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে (এফবিআই) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় বসে তিনিই উল্টো ওই দুটি সংস্থার প্রধান হিসেবে নিঃশর্ত আনুগত্যশীল ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছেন।
সীমাহীন নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ-
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগ- এই তিনটি স্তরে বিভক্ত। কিন্তু ট্রাম্প এই ক্ষমতার ভারসাম্য মানতে নারাজ। তিনি দাবি করছেন, সংবিধানের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগকে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁর এই অবস্থান তথাকথিত ‘ইউনিটারি এক্সিকিউটিভ থিওরি’র সঙ্গে মিলে যায়, যা রক্ষণশীল পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করে আসছেন।
এই যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগীয় নিরীক্ষকের পদ বাতিল করেছেন, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এছাড়া সরকারি ব্যয় সংকোচনের কথা বলে ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থা থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিমানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, কর বিভাগ, স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা দপ্তর এমনকি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও। সমালোচকদের মতে, এ সবই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা-
ট্রাম্প প্রশাসন ফেডারেল কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ অর্থ বাতিল করছে, যা কংগ্রেস অনুমোদিত। অথচ তিনি বলছেন, এটি ব্যয় সংকোচনের জন্য করা হয়েছে। ইলন মাস্ক দাবি করেছিলেন, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ৫৫ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকৃত সাশ্রয়ের পরিমাণ শূন্য।
ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতির কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। নতুন আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভোক্তাদের আস্থা কমতে শুরু করেছে। রয়টার্সের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র চার সপ্তাহের ব্যবধানে ট্রাম্পের সমর্থনের হার ৫১ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৪১ শতাংশে।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ-
ট্রাম্পের কার্যক্রমের ফলে আইনের শাসনের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারেন বলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন। টিকটক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তিনি ইতোমধ্যে এর প্রমাণ রেখেছেন।
সম্প্রতি ট্রাম্প নেপোলিয়নের একটি উক্তি তুলে ধরে বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থে কোনো কাজই বেআইনি নয়।’ এর অর্থ- তিনি নিজের যেকোনো সিদ্ধান্তকে জাতীয় স্বার্থের নামে বৈধতা দিতে পারেন।
তবে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় বিশ্লেষকদের ধারণা, আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার প্রভাব বোঝা যাবে। ট্রাম্পের নীতির কারণে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে- তা নির্ধারণ করবে ভোটাররাই।