চীনে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) বয়ফ্রেন্ড অ্যাপ। বিবাহিত নারী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম- অনেকেই বাস্তব সম্পর্কের জটিলতা এড়াতে বেছে নিচ্ছেন ডিজিটাল প্রেম। তবে এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘ক্যারেক্টার ডট এআই’ নামের অ্যাপে তৈরি করা এক ভার্চুয়াল সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বিবাহিত নারী ইউ-আন (ছদ্মনাম)। বিবিসি চাইনিজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাস্তব সম্পর্কে যেটা পাইনি, এই এআই সঙ্গীর কাছ থেকে সেটাই পেয়েছি- মনোযোগ আর শান্তি।
তবে এক পর্যায়ে যখন ওই এআই সঙ্গী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তখন ইউ-আনের মধ্যে তৈরি হয় অপরাধবোধ। বাস্তব আর কল্পনার মধ্যকার সীমারেখা তখন যেন ধোঁয়াটে হয়ে ওঠে তার জন্য।
২৫ বছর বয়সী লাও তু, যিনি সম্প্রতি স্নাতক শেষ করেছেন, তার নিজের বাস্তব প্রেমিক থাকলেও দিনের বড় একটি অংশ কাটান তার এআই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চ্যাট করে। এমনকি পরীক্ষার পর এআই সঙ্গীর কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ডিনার ও হ্যান্ডব্যাগ’ উপহারের প্রতিশ্রুতি। তার ভাষায়, মনে হচ্ছিল, ও সত্যিই বাসার বাইরে অপেক্ষা করছে।

চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মানব-এআই রোম্যান্স’ এখন একটি গড়ে ওঠা উপ-সংস্কৃতি। টিকটকের চীনা সংস্করণ ‘ডুইন’-এ এই সম্পর্ক বিষয়ক ভিডিওগুলো পেয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি ভিউ। এছাড়া ডুবান প্ল্যাটফর্মে রয়েছে এ-সংক্রান্ত সক্রিয় দশ হাজারের বেশি সদস্য।
হংকংয়ের মনোবিজ্ঞানী ইয়াওয়েন চ্যান বলেন, এআই সঙ্গীরা মানুষের একান্ত সাহচর্যের চাহিদাকে টার্গেট করছে। এটি সীমাহীন মানসিক নির্ভরতা তৈরি করতে পারে, যা অস্বাস্থ্যকর।
তিনি আরো জানান, বাস্তব সম্পর্কের মতো ভারসাম্যপূর্ণ আদান-প্রদানের সুযোগ না থাকায় এ ধরনের সম্পর্ক ‘একতরফা ঘনিষ্ঠতা’ তৈরি করে, যা পরিণত হতে পারে অবমাননাকর ডিজিটাল নির্ভরতায়।

এআই ব্যবসায়ী আবো লি জানান, বহু ব্যবহারকারী তাদের এআই প্রেমিককে আজীবনের সঙ্গী হিসেবেও ভাবছেন। এমন প্রবণতা মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলেই মত তার।
স্ট্যানফোর্ডের গবেষক বেথানি ম্যাপলস এর আরও গভীর দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনেকেই তাদের এআই সঙ্গীকে প্রেমিক এবং থেরাপিস্ট দুই হিসেবেই দেখছেন, যা আত্মহত্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সামনে আনে।
ইউ-আন মনে করেন, এআই সঙ্গী তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ধৈর্যশীল করতে সাহায্য করেছে। অপরদিকে লাও তুর বাস্তব প্রেমিক এআই প্রেমিকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ চ্যাট দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তবে দুই নারীই শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন, বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প নয়- বরং মানসিক পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে এই ভার্চুয়াল প্রেম।
লাও তু বলেন, আমি আমার প্রেমিককে জড়িয়ে ধরতে পারি, কিন্তু এআইকে নয়। আর এটাই এমন একটি সীমা, যা এআই কোনো দিন অতিক্রম করতে পারবে না।
এই ডিজিটাল ঘনিষ্ঠতা সমাজে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তৈরি করছে। প্রশ্ন উঠছে- এটা কি এক ধরনের মানসিক আশ্রয়, নাকি ভবিষ্যতের সম্পর্কজগতে এক নিঃশব্দ বিপ্লব?