ঢাকা এবং চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবা ব্যবহারের পর থেকে এ খাতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত: সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সত্ত্বেও নির্ধারিত ভাড়া এবং দৈনিক জমার হার কার্যকর করার বিষয়টি বার বার হোঁচট খেয়েছে। চালক ও মালিকদের অসহযোগিতা এবং তাদের দাবির মুখে সড়ক অবরোধের ঘটনা মানুষের জীবনে বিশাল দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
এ প্রতিবেদনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার নৈরাজ্য, এর মূল কারণ এবং সমাধানে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে:
অটোরিকশার সংকট এবং সড়ক অবরোধ-
২০০৩ সালে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে গণপরিবহন হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার অন্তর্ভুক্তি শুরু হয়। তখন থেকেই ভাড়া নির্ধারণের পরও মালিক এবং চালকরা তা মানতে চাননি। সরকার তাদের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে বাধা তৈরি করেছে বিভিন্ন আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ। যেমন, ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা সরকারের নির্ধারিত নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে সড়ক অবরোধ করে। এ ঘটনা রাজধানী ঢাকার রামপুরা, মিরপুর, গাবতলী, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘটে। যার ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং জনসাধারণ দুর্ভোগে পড়ে। এমনকি সরকারি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ সভাতেও সময় মতো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
ভাড়া ও জমার নির্ধারিত হার এবং তার বাস্তবায়ন-
ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য ভাড়া ও মালিকদের জন্য দৈনিক জমার একটি নির্ধারিত হার রয়েছে। বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) এই হার কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করেছে। তবে এটি বাস্তবায়িত হয়নি। অনেকবার ভাড়া এবং জমার হার বাড়ানো হলেও তা কখনোই সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। এমনকি চালকরা যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী গন্তব্যে না গিয়ে- তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া চেয়ে থাকেন। সরকারের চলমান পদক্ষেপগুলি যখনই কঠোর হতে চেয়েছে, তখনই মালিক এবং চালকদের পক্ষে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, যা সরকারের উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলন-
অটোরিকশা মালিক এবং শ্রমিকরা একাধিকবার সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাদের দাবির মধ্যে অন্যতম হলো, তাদের নির্ধারিত জমার হার বাড়ানো এবং ভাড়া পুনরায় বৃদ্ধি করা। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল জনস্বার্থে অটোরিকশার সেবা নিয়ন্ত্রণে রাখা কিন্তু মালিক এবং চালকদের বারবার দাবি এবং আন্দোলন সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করতে বাধ্য করেছে। সর্বশেষ, ২৬ জানুয়ারি বিআরটিএ পুলিশকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি পাঠালেও তা সড়ক অবরোধের পর প্রত্যাহার করতে হয়।
অটোরিকশা মালিক এবং শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের আয়ের অনুপাতে ভাড়া এবং জমা বৃদ্ধি অপরিহার্য। যেমন: একেকটি অটোরিকশার মালিক দৈনিক ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করেন- যা তাদের ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় বলে তারা দাবি করেন।
নৈরাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা-
বাংলাদেশে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সেবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই দশক ধরে এর নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিআরটিএ বারবার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চাইলেও চালক এবং মালিকদের মধ্যে সমঝোতার অভাব এবং তাদের একযোগিতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, যদি কোনো চালক নির্ধারিত ভাড়া থেকে বেশি ভাড়া দাবি করেন বা যাত্রীকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না নিয়ে যান- তাহলে তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ প্রতিরোধ করা হচ্ছে মালিক ও চালকদের পক্ষ থেকে নানা আন্দোলন ও তৎপরতার মাধ্যমে।
অটোরিকশার মালিকানা এবং আয়-
অটোরিকশার মালিকরা তাদের গাড়ির ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এটি তাদের জন্য লাভজনক একটি ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে একেকটি নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা মূলত নিবন্ধনের সুযোগের মধ্যে এক ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলস্বরূপ ঘটে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে প্রাইভেট গাড়ি এবং মোটরসাইকেল বাড়লেও, সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা নির্দিষ্ট এবং এর আয় অনেক বেশি হওয়ায় মালিকরা নতুন গাড়ি কেনার জন্য আগ্রহী। এ পরিস্থিতি বাজারে অটোরিকশার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে পুরো খাতের নিয়ন্ত্রণ সুশৃঙ্খল করা কঠিন করে তুলেছে।
সমাধানের পথে নতুন উদ্যোগ-
প্রকৌশলবিদরা এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোরিকশা সেবা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বড় ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর নীতিমালা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এককভাবে তাদের অধীনে শক্তিশালী কোম্পানি নিয়ে আসে, তবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
নিষ্কর্ষ-
সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও মালিক ও চালকদের একাত্মতার কারণে সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে যদি সমাধান না আসে, তবে এটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।