বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বহুদিন ধরেই একটি ধারণা প্রচলিত। ভারত সবসময় আওয়ামী লীগকেই একমাত্র রাজনৈতিক বন্ধু হিসেবে দেখেছে। বিএনপিকে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। এটি কারও অজানা নয়।
ভারতের কূটনীতিকরা বলেন, বিএনপির শাসনামলে ভারত বিশেষ কিছু পায়নি। বরং আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়নি। তবে বিএনপি বলে, তারা কখনোই নতজানু নীতিতে চলে না। তারা সব দেশকে সমান মর্যাদা দিয়ে দেখে। তারা আরও বলে, ভারতের বিরোধিতা করা তাদের নীতি নয়।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক থাকলেও বিজেপির সঙ্গে নতুন সমীকরণ সম্ভব।
দিল্লি শুরুতে কিছুটা ইতিবাচক ছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক আর গভীর হয়নি। বরং মোদী ও শেখ হাসিনার মধ্যে দ্রুত ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এটি দুই দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত করে তোলে।
বাংলাদেশের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে ভারতের নিরব সমর্থন বিএনপির মধ্যে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
ভারতের রাজনীতি ও কূটনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি যদি ভারতের কিছু চাহিদায় সাড়া দেয়, তবে ভারতও সম্পর্ক গড়তে রাজি হতে পারে।
এখন আওয়ামী লীগের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ভালো করতে পারে—এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকের মতে, ভারতের কাছে খালেদা জিয়ার দল এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প।
ভারতের ঢাকাস্থ সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল না। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, “আমরা সরকার-সরকার পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশি কাজ করেছি। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে ছিল না—এটা সঠিক নয়।”
তিনি জানান, দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বহুবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, ভারতের প্রতি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিদলে বিএনপির এমপিরাও ভারত সফরে যেতেন। তাই সম্পর্ক একেবারে ছিল না—এমন ধারণা ভিত্তিহীন।
তবে বিএনপি ও ভারতের মধ্যে আস্থার অভাব ছিল—এটি দুই পক্ষই স্বীকার করে। ২০১৪ সালের পর বিএনপির নেতারা দিল্লিতে বিজেপি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। রাম মাধবের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এমনকি ঢাকায় দুর্গাপূজায় আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক গড়েনি। বরফ গলেনি।
বর্তমানে বিজেপির অনেক নেতা অন্য কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার আগে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বিজেপি নেতা ও সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলাদেশে বসবাসকারী ঘোষ, বসু, দত্ত, গুপ্তা, মতুয়া, জয়সওয়াল বা বৌদ্ধরা আমাদের ভাই। তারা যদি ভারত চলে আসতে বাধ্য হয়, তাহলে সেটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা চাই বাংলাদেশে স্বচ্ছ গণতন্ত্র ফিরুক। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। দেশটি মৌলবাদমুক্ত হোক।”
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অনেকেই বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা ভারতে চলে আসবে। বাস্তবে তা ঘটেনি। তবে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এখনো সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি বলছে, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই হোক না কেন, সম্পর্কের আগে তারা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চায়।
একজন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক, যিনি ঢাকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, মজা করে বিএনপিকে ডাকতেন ‘ভারতে নারাজ পার্টি’। দিল্লির দক্ষিণ ব্লকে অনেকের বিশ্বাস, বিএনপির রাজনৈতিক শক্তির পেছনে ভারত বিরোধিতা ছিল একটি বড় বিষয়। যদিও বিএনপি বলেছে, তারা শুধু সম্মানজনক সম্পর্ক চায়। তারা ভারতবিরোধী নয়।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—বিএনপি কি পুরনো অবস্থান থেকে সরে এসেছে?
মরিশাসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ভারতের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শান্তনু মুখার্জি বলেন, “বিএনপি এখন অনেক বেশি সক্রিয়। তবে তাদের আগের কথাও মনে রাখতে হবে। তারা বলেছিল, ভারতের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা হবে বা বাতিল করা হবে।”
তার মতে, এসব বক্তব্য নির্বাচনী কৌশলও হতে পারে। কারণ বিএনপি অনেক বছর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু তারা কি সত্যিই ভারতকে নিয়ে নতুন একটি বিশ্বাসের অধ্যায় শুরু করতে চায়—তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
এই সম্ভাব্য পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককেই নয় বরং পুরো উপমহাদেশের কূটনীতিক সমীকরণকেও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।