বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রতীক সংকট যেন একটি পুরনো অভিশাপ। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর, আবারও সেই সংকটের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। একসময়ের পেঁপে, মুলা, খাট, বালতি কিংবা পেঁয়াজ প্রতীক ফিরিয়ে আনতে হতে পারে—সেই শঙ্কাই এখন উঁকি দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনের করিডোরে।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যেমন ১৪০টি প্রতীক নির্ধারণ করতে হয়েছিল, এবারও তেমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। কারণ, নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের দরজায় কড়া নাড়ছে ১৪৪টি নতুন রাজনৈতিক দল। বর্তমানে নিবন্ধিত ৫০টি দলের সঙ্গে মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়াতে পারে ২০০-এর কাছাকাছি। এ অবস্থায় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বর্তমানে সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় নির্ধারিত প্রতীক মাত্র ৬১টি। কিন্তু যদি সবগুলো আবেদনকারী দল নিবন্ধন পায়, তাহলে দরকার হবে অন্তত ১৪৭টি প্রতীক। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যও রাখতে হবে আলাদা প্রতীক। সেই হিসেব মেলাতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে নতুন প্রতীক।
ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সম্প্রতি বলেন, “আমরা নতুন প্রতীক খুঁজছি, কারণ দল বাড়লে প্রতীকও বাড়াতে হবে। এ নিয়ে কমিশনে আলোচনা চলছে।” তার ভাষ্য, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতীকের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতীক নির্বাচন হবে সতর্কতার সঙ্গে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় দল নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল না। ফলে নামসর্বস্ব দলও সহজেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারত। সে সময় ১১১টি দল প্রতীকের জন্য আবেদন করেছিল। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব, অতীত ইতিহাস, নির্বাচনী পারফরম্যান্স বিবেচনায় রেখেই প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছিল। একই প্রতীকের জন্য একাধিক আবেদন এলে অনেক সময় লটারিও করতে হয়েছিল।
সে সময় নির্ধারিত ১৪০টি প্রতীকের তালিকায় ছিল—চাকা, তীর-ধনুক, ফুলকপি, চাবি, কেতলি, আনারস, পেঁপে, ডাব, ঘুড়ি, রেলওয়ে ইঞ্জিন, কলার ছড়ি, সেলাই মেশিন, হাতঘড়ি, চরকা, মাইক, ঘড়ি, মাছ, গরুরগাড়ি, হাতি, ট্রাক, রকেট, বটগাছ, টেলিভিশন, হেলিকপ্টার, উট, সিংহ, দাঁড়িপাল্লা, শীলপাটা ইত্যাদি। এদের অনেককেই পরে বাতিল করা হয় মিল বা ভুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনায়।
এইবার নিবন্ধনের আবেদন করা অনেক দল পুরোনো তালিকায় না থাকা প্রতীক চাইছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি চাইছে শাপলা, কলম কিংবা মোবাইল ফোন। জনতা পার্টি চাইছে হাতি প্রতীক, আর জনতার দল চেয়েছে চাবি। প্রশ্ন উঠেছে—শাপলা কি ধানের শীষের সঙ্গে মিলে যাবে? আবার মোবাইল ফোন বা কলম প্রতীক কি গ্রহণযোগ্য? সুপ্রিম কোর্টের ১০১ জন আইনজীবী অবশ্য বলছেন, শাপলা দিতে কোনো আইনি বাধা নেই।
ইসি এখন নতুন প্রতীক নির্ধারণ করতে চায়, কিন্তু তা করতে গিয়ে অতীতের কিছু বিতর্কও মাথায় রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল চকোলেট, পুতুল, কাঁচি, ভ্যানিটি ব্যাগ, গ্যাসের চুলা, হারমোনিয়াম—যা তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তখন নারী নেত্রীরা একে ‘পিতৃতান্ত্রিক ও অপমানজনক’ প্রতীক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এই বিতর্ককে সামনে রেখেই ইসি এখন প্রতীক বাছাইয়ে আরও সতর্ক।
যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আরও নতুন প্রতীকের প্রয়োজন হবে। কারণ দলীয় প্রতীক বাদ দিলে মেয়র, চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানদের জন্য নতুন প্রতীক বরাদ্দ করতে হবে। আবার একই রকম দেখতে প্রতীকও নির্বাচন কমিশন বরাদ্দ দিতে চায় না। যেমন—নৌকা ও জাহাজ। জাহাজ বাদ দেওয়া হয় নৌকার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকার কারণে। গম বা জবের শীষও ধানের শীষের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বাদ গেছে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, প্রতীক সংকট শুধু একটি কারিগরি সমস্যা নয়। এটি রাজনৈতিক বাস্তবতা, দলীয় বিভাজন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও জনআস্থার বিষয়গুলোর প্রতিচ্ছবি। প্রতীক মানে শুধু একটি চিহ্ন নয়, এটি একটি দলের পরিচয়, তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস, এবং মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। সে কারণে প্রতীক নির্ধারণে যতটা জরুরি সংখ্যা, তার চেয়েও বেশি জরুরি যুক্তি, গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মানবোধ।
নির্বাচন কমিশন এখন যে পথে হাঁটছে, তাতে শুধু প্রতীক বাড়ানো নয়, একটি সচেতন এবং পরিপক্ব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচয়ও তুলে ধরার সুযোগ আছে।