বাংলাদেশের সমাজে অনেক সময় রাগ বা অভিমানের বশে পিতা-মাতা সন্তানকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দেন। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার এমন ঘোষণা সমাজে প্রচলিত হলেও আইনের চোখে এর কোনো ভিত্তি নেই। এটি নিছক ভ্রান্ত ধারণা মাত্র, যা অনেক অভিভাবক সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে ব্যবহার করেন। বাস্তবিক অর্থে, আইনি কাঠামোতে সন্তানের অধিকার সংরক্ষিত এবং ত্যাজ্য ঘোষণার মাধ্যমে তা খর্ব করা যায় না।
একটি সাম্প্রতিক ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। কাবির ও রুমা, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। তারা ভালোবাসার সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আইনগতভাবে তাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি তাদের পরিবার। পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ত্যাজ্য ঘোষণা করেন এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেন।
এটি আমাদের সমাজে একটি চেনা চিত্র, যেখানে অভিভাবকরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা দিয়ে সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। তবে এতে সন্তানদের উত্তরাধিকারের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ, মুসলিম পারিবারিক আইনে উত্তরাধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে। এ আইনে বলা আছে যে, মুসলিম সন্তানরা তাদের পরিবারের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবে এবং এই অধিকার তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। তবে, পিতা-মাতা যদি জীবদ্দশায় তাদের সম্পত্তি দান, উইল বা বিক্রয়ের মাধ্যমে অন্য কাউকে প্রদান করতে চান, তবেই সেটি বৈধ হবে। যদিও মুসলিম আইনে উইলের ক্ষেত্রে পৈতৃক সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি হস্তান্তর করা যায় না এবং এটি কার্যকর হবে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর।
অর্থাৎ, কোনো পিতা-মাতা যদি জীবদ্দশায় সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেও কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রয় না করেন। তবে মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার সন্তানদের প্রতি সংরক্ষিত থাকবে। কোনো ঘোষণার মাধ্যমেই এই অধিকার বাতিল করা সম্ভব নয়।
আইন অনুযায়ী, যদি কোনো বাবা-মা সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে যান এবং অন্য অংশীদারেরা সেই ঘোষণা ব্যবহার করে তাদের সম্পত্তি বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন। তবে সন্তানরা আইনত প্রতিকার চাইতে পারে। এক্ষেত্রে ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইন অনুসারে, ৫০০ টাকা কোর্ট ফি জমা দিয়ে দেওয়ানি আদালতে বাটোয়ারা মামলা করা যেতে পারে।
তবে, আইন অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া সম্ভব। মুসলিম আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে নরহত্যার অপরাধ বা ধর্মান্তরের কারণে সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকার হারাতে পারে। অর্থাৎ, যদি কোনো সন্তান তার পিতা-মাতাকে হত্যা করে বা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে। তবে সে আইনের দৃষ্টিতে উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে না।
অন্যদিকে, হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আরও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-ধর্মান্তরিত হওয়া, দুশ্চরিত্র বলে বিবেচিত হওয়া, শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা, হত্যাকারী হওয়া বা সন্ন্যাস গ্রহণ। এসব ক্ষেত্রেও উত্তরাধিকার বাতিল হতে পারে।
অতএব দেখা যায় যে, সন্তানের প্রতি ত্যাজ্য ঘোষণার প্রচলিত সামাজিক রীতি এবং আইনগত বাস্তবতার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কোনো সন্তানের প্রতি ত্যাজ্য ঘোষণা দিলেই তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। আইন অনুযায়ী প্রতিটি সন্তান পিতা-মাতার সম্পত্তিতে তার প্রাপ্য অধিকার লাভে সমানভাবে সক্ষম।