বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা নতুন নয়৷ তবে বিচারক মো. আবু সাঈদের সাম্প্রতিক বদলি আদেশ এ বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিচারকদের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করায় এক ধরনের শাস্তিমূলক বদলির মুখে পড়েছেন তিনি।
গত শনিবার যশোরে এক কর্মশালায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিচারকদের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে মন্তব্য করেন। পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে “বিচারকদের জামিন দেওয়ার একচ্ছত্র অধিকার নেই” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগে প্রেষণে থাকা সিনিয়র সহকারী জজ মো. আবু সাঈদ বিচারকদের একটি ব্যক্তিগত ফেসবুক গ্রুপে নিজের মতামত প্রকাশ করেন।
সেখানে তিনি লিখেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য বেআইনি ও অসাংবিধানিক। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭ ও ৪৯৮ ধারার উল্লেখ করে বলেন, বিচারকদের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা শর্তসাপেক্ষ হলেও তা একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা না করে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধানের ৯৪ (৪) ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচারকরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবেন এবং এই স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব সবার।
বিচারক আবু সাঈদের পোস্টের স্ক্রিনশট অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে পৌঁছালে বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর পরপরই গত বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক আদেশে তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে বদলি করা হয়।
বিচার বিভাগ ও আইনজীবীদের অনেকেই এই বদলিকে “অন্যায্য ও প্রতিশোধমূলক” বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এর আগে, পঞ্চগড় লিগ্যাল এইড অফিসে থাকাকালীন সরেজমিনে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। এরপর প্রধান বিচারপতির বিশেষ উদ্যোগে তাঁকে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রিতে আনা হয়।
এই বদলির আদেশের পর বিচারকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিচারক আবু সাঈদের পোস্টের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে অনেক বিচারক তা পুনরায় শেয়ার করেন। তাঁদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অশনি সংকেত এবং এটি বিচারকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে ভয় ও বাধার সৃষ্টি করেছে।
এটি প্রথম নয়, এর আগেও বিচারক আবু সাঈদকে বিতর্কিত বদলির শিকার হতে হয়েছিল।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি নাটোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা গায়েবি মামলায় আসামিদের জামিন দেন এবং পুলিশের যথেচ্ছ গ্রেপ্তারের বিষয়ে থানার ওসিদের তলব করেন। এরপর তাঁকে পঞ্চগড় লিগ্যাল এইড অফিসে বদলি করা হয়। সে সময়ও বিচার বিভাগে এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।
এছাড়াও, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতার শিকার হন। তাঁর জন্মস্থান বগুড়া হওয়ায় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে সন্দেহ করে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নিয়োগ দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়।
এই ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে— বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটুকু কার্যকর? বিচারকদের পেশাগত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু আছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। বিচারকরা যদি তাঁদের দায়িত্ব পালনের কারণে শাস্তির শিকার হন। তবে সেটি আইনের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই বদলি আদেশ শুধু বিচারক আবু সাঈদের ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং এটি পুরো বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, উচ্চ আদালত বা বিচার বিভাগীয় সংস্থাগুলো এ নিয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানায় এবং কোনো পদক্ষেপ নেয় কি না।