যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ দুই চীনা নাগরিকের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীতে গোয়েন্দা নিয়োগের চেষ্টার অভিযোগ এনেছে। অভিযুক্তরা হলেন ইউয়ান্সে চেন (৩৮) এবং লিরেন ‘রায়ান’ লাই (৩৯)। গত শুক্রবার (২৭ জুন) তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং সোমবার সান ফ্রান্সিসকোর ফেডারেল আদালতে মামলাটি উন্মোচন করা হয়।
অভিযোগের বিবরণ-
মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর এক হলফনামা অনুসারে, চেন এবং লাই চীনের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি (এমএসএস)-এর হয়ে গোপনে কাজ করছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর ঘাঁটি এবং কর্মীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, গোপন অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা করা এবং নৌবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সম্ভাব্য গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। এই কার্যক্রমগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
২০২১ সাল থেকে লাই চেনকে এমএসএস-এর জন্য একজন সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। চেন, যিনি ২০১৫ সালে ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন এবং লাই, যিনি এপ্রিল ২০২৫-এ পর্যটক ভিসায় টেক্সাসে এসেছিলেন, গোপন অভিযান পরিচালনার জন্য একযোগে কাজ করেছেন।
গোপন কার্যক্রম-
২০২২ সালের জানুয়ারিতে চেন এবং লাই ক্যালিফোর্নিয়ার লিভারমোরে একটি বিনোদন কেন্দ্রের লকারে ১০,০০০ ডলার নগদ রেখে ‘ডেড ড্রপ’ পদ্ধতিতে অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা করেন। এই অর্থ জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্যের বিনিময়ে দেওয়া হয়েছিল। চেনের স্ত্রী এই লেনদেনে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ আছে। তিনি একটি কালো ব্যাকপ্যাক নিয়ে লকার রুমে প্রবেশ করেন এবং তথ্য রেখে চলে যান, যা নজরদারি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
এছাড়া চেন ২০২২ ও ২০২৩ সালে ওয়াশিংটন রাজ্যের একটি নৌঘাঁটি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সান গ্যাব্রিয়েলে একটি নৌ নিয়োগ কেন্দ্রে গিয়ে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের নাম, জন্মস্থান এবং অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেন। এই তথ্যগুলোর মধ্যে অনেকের জন্মস্থান হিসেবে চীন উল্লেখ ছিল এবং এফবিআই-এর ধারণা, এই তথ্য চীনে পাঠানো হয়। একটি ঘটনায়, চেন লাইকে একজন নৌ কর্মীর সম্পর্কে বার্তা পাঠান, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “তার মা চীনা। বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না, আট বছর বয়সে তার মায়ের কাছে তাকে দেওয়া হয়। এজন্য সে তার মায়ের পদবি ব্যবহার করে।”
২০২৩ সালে চেন সান ডিয়েগোতে ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন নামক বিমানবাহী জাহাজ পরিদর্শন করেন এবং একজন নৌ কর্মী ও তাঁর সন্তানের সঙ্গে ছবি তোলেন। এফবিআই-এর হলফনামায় এই ছবি এবং চেনের ভিজিটর ব্যাজ দেখা গেছে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে চেন চীনের গুয়াংঝৌতে গিয়ে এমএসএস-এর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কাজ এবং পারিশ্রমিক নিয়ে আলোচনা করেন।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট-
মার্কিন বিচার বিভাগ জানিয়েছে, এই মামলা চীনের গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি ধারাবাহিকতার অংশ। ২০২৩ সালের আগস্টে দুই নৌসেনা সদস্যের বিরুদ্ধে চীনকে সামরিক তথ্য সরবরাহের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার মধ্যে যুদ্ধকালীন মহড়া, প্রযুক্তিগত বিবরণ এবং নৌবাহিনীর মোতায়েন সম্পর্কিত তথ্য ছিল। এফবিআই-এর পরিচালক কাশ প্যাটেল বলেন, “চীনা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেছিল, তারা গোপনে আমাদের ভূখণ্ডে কাজ করে পার পেয়ে যাবে। এই মামলা এফবিআই-এর সান ফ্রান্সিসকো, পোর্টল্যান্ড, হিউস্টন এবং সান ডিয়েগো শাখার সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল।”
চীনের ওয়াশিংটন দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ বলেন, তিনি এই মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ “কোনো তথ্য বা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে নয়।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তুলে পাল্টা দাবি করেন।
আইনি পরিণতি-
চেন এবং লাই-এর বিরুদ্ধে ফরেন এজেন্ট রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট (ফারা) লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে, যা বিদেশি সরকারের হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে মার্কিন বিচার বিভাগে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের প্রত্যেকের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২৫০,০০০ ডলার জরিমানা হতে পারে। মামলাটি এফবিআই-এর সান ফ্রান্সিসকো শাখা তদন্ত করছে এবং নৌ গোয়েন্দা সংস্থা (এনসিআইএস) সহায়তা প্রদান করেছে।
মার্কিন অ্যাটর্নি ক্রেইগ এইচ মিসাকিয়ান বলেন, “এই অভিযোগগুলো আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে লক্ষ্য করে বিদেশি শক্তির ব্যাপক প্রচেষ্টার প্রতিফলন। আমরা এমন গুপ্তচরবৃত্তির তদন্ত এবং বিচার অব্যাহত রাখব, যাতে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা পায়।” এফবিআই জানিয়েছে, চীন দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌবাহিনীর ‘ব্লু-ওয়াটার’ সক্ষমতা বাড়াতে এমন গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।