বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ (স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট) সবসময়ই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলো। মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে এই আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে বারবার। এর প্রভাব এবং ফলাফল আজও আমাদের চোখের সামনে প্রকট। সাম্প্রতিক সময়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন, তাদের অনেকেই ফিরে আসায় এই কালো আইন এবং এর প্রয়োগ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা একসময় সরকারি দপ্তর থেকে দপ্তরে ছুটেছেন তাদের প্রিয়জনদের সন্ধান পেতে কিন্তু কোনও উত্তর মেলেনি। অনেকে মাসের পর মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর হঠাৎ ফিরে এসেছেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের। আবার অনেকেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এসব ঘটনা দেশের সব রাজনৈতিক ক্ষমতাধারী দলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে। এই কালো আইনের আশ্রয়ে তারা বিভিন্ন স্বার্থ হাসিল করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
অনেক গণমাধ্যমেই সম্প্রতি এ বিষয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীরা আয়নাঘরের কথা উল্লেখ করেছেন। আয়নাঘর, যা আসলে একটি বন্দিশালা, সেখানে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো। যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধ প্রমাণ হয়নি, অথচ তারা রাজনীতির শিকার। এসব ঘটনা জানার পর আমাদের সামনে প্রশ্ন জাগে—মানবাধিকারের এমন লঙ্ঘনের পেছনে আমাদের আইনি ব্যবস্থার ভূমিকা কী ছিলো?
বাংলাদেশে নিখোঁজ বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ একটি নির্দয় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই আইনের ধারাগুলোতে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিঃশব্দ করার বিধান রয়েছে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো এই আইনের ধারা-৯, যার অধীনে একজন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটক রাখা যায়। বিচারপতি এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা বোর্ড আটকের পুরো বিষয়টি তদারকি করে। যদিও সংবিধান ও ফৌজদারি আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে, এই আইনে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তিকে আটক করা হলেও, তার আটক সম্পর্কে জানানো নাও হতে পারে।
উপদেষ্টা বোর্ড সরকারের কাছে প্রতি ১৭০ দিনে আটক ব্যক্তির সম্পর্কে রিপোর্ট জমা দেয়। তবে এটিও এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে নির্যাতন এবং অবৈধ আটকের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি ন্যূনতম সুবিচার হয় না। এমনকি, ধারা-১১(৪) অনুসারে আটক ব্যক্তিকে আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
ধারা-২৭ এর অধীনে অপরাধীর অনুপস্থিতিতেই শুধুমাত্র একটি পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। এই ধারা থেকে বুঝাই যায়, আইনটি মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিলো।
আরও ভয়াবহ হলো, আইনের ধারা-৩৪, যা নির্যাতন ও গুমের অভিযোগের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই ধারা অনুসারে, গুম বা নির্যাতনের মতো গুরুতর অভিযোগের বিচার চাইতে গেলে তা রাষ্ট্রের স্বার্থে সরল বিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি, ধারা-৩৪-ক অনুযায়ী, অপরাধীর রায় কার্যকর করতে গুলি করে হত্যার বিধানও রাখা হয়েছে।
এই আইন কি ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়? এই প্রশ্নের জবাব আইনবিদদের বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, আজ আর কেবল একটি আইন নয়, এটি একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিবেচিত হবে। এই আইনের সংস্কার এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যেমন সকলেই সরব আছেন, তেমনি এই আইনের ক্ষেত্রেও জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে। নতুন বাংলাদেশের কল্যাণার্থে এই মানবতাবিরোধী আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে।
অতীতের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিচার করতে হবে। অন্যথায়, আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ অধরাই থেকে যাবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে হলে এই আইন পরিবর্তন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।