মানবিক আইন প্রথম ব্যবহার করেন Jean Pictet । সেজন্য তাকে মানবিক আইনের জনক বলে অবহিত হয়ে থাকে। তার মতে, “মানবিক আইন হলো আন্তর্জাতিক আইনের সেই অংশ যা মানবতার অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং যা যুদ্ধের সময় ব্যক্তি বিশেষকে কে রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে নিবেদিত”। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে জেনেভাকনভেনশন গুলোকে বোঝাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি প্রথম মানবিক আইন শব্দটি ব্যবহার করে, তখন এটি যুদ্ধ সংক্রান্ত আইনের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হতো ।
মানবিক আইন জাতীয় সংবিধান বা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়েও আন্তর্জাতিক আইনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
ফলে আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায় এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানবিক আইনের বড় সীমাবদ্ধতা হলো যে, এটি বাস্তবায়নের জন্য তেমন মেশিনারি নাই। রাষ্ট্রসমূহের নিজস্ব দায়-দায়িত্ব, বাস্তবায়নের ঝুঁকি, মানুষের সচেতনতা ইত্যাদির ওপর এর কার্যকারিতা নির্ভরশীল।
জেনেভা আইন ও হেগ আইন – দুটি শাখায় মানবিক আইন বিভক্ত। দুটো আইনই যুদ্ধের সময় প্রযোজ্য। তবে জেনেভা আইন যুদ্ধ এলাকায় অবস্থানরত যুদ্ধে কিন্তু অংশগ্রহণ করেনি এমন ব্যক্তিদের অধিকার ও দায়-দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। অপরদিকে হেগ আইন যুদ্ধে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যুদ্ধকালে তাদের অধিকারও কর্তব্যের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ হেগ আইন প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত । সেজন্য এটিকে যুদ্ধ আইন নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ১৯৭৭ সালের জেনেভা কনভেনশন গুলোর পরিপূরক হিসেবে দুটি অতিরিক্ত প্রোটোকল গ্রহণ করা হয় এবং প্রটোকল দুটি গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে জেনেভা আইন ও হেগ আইন একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
বস্তুত, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ১৯৪৯ সালের ৪টি জেনেভা কনভেনশন, ১৯৭৭ সালের দুটি প্রটোকল এবং তথাগত আইনের বিধি-বিধানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। রেড ক্রিসেন্ট এর একদল আইনবিদের মতে, মানবিক আইনের বেশ কিছু মূলনীতি রয়েছে। সেগুলি হলো-
যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অথবা যারা hors de combat ঘোষিত হয়েছে সেসব ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সহ জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোন প্রকার বৈষম্য ব্যতীত যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের সংরক্ষণ ও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।
শত্রুপক্ষের যেসব সৈনিক আত্মসমর্পণ করেছে অথবা hors de combat ঘোষিত হয়েছে তাদেরকে হত্যা বা জখম করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
যুদ্ধমানপক্ষ এবং তাদের সৈনিকদের কোনোভাবেই যুদ্ধের ব্যাপারে অসীম ক্ষমতা প্রদান করা যাবে না।
যুদ্ধমান পক্ষের হাতে আটকৃত আহত ও পীড়িত সৈন্যদের খোঁজখবর রাখা ও তাদের যত্ন নেওয়া রেড ক্রিসেন্ট এর দায়িত্ব। যুদ্ধক্ষেত্রে যারা স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত থাকে তাদেরকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতীক মেনে চলতে হবে।
দখলকৃত পক্ষের নিকট আটককৃত যুদ্ধবন্দী ও সামরিক নাগরিকদের জীবন, মর্যাদা ও ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। তারা সকল প্রকার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং তাদের নিজ পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার অধিকার থাকবে।
বেসামরিক জনগণ ও তাদের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য যুদ্ধমান পক্ষগুলো বেসামরিক ব্যক্তি ও যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করবে। বেসামরিক কোন ব্যক্তি আক্রমণের বিষয়বস্তু হতে পারবে না। কেবলমাত্র সামরিক স্থাপনা সমূহের উপরই আক্রমণ করা যাবে।
প্রত্যেকের মৌলিক বিচারের নিশ্চয়তা পাওয়ার অধিকার থাকবে। নিজে যুক্ত ছিলো না এমন অপরাধের জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা যাবে না। কাউকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। এছাড়া যৌথ শাস্তি কিংবা নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেয়া যাবে না।
জেনেভা কনভেনশন ও হেগ কনভেনশনের উপর ভিত্তি করে মানবিক আইন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। পক্ষান্তরে, প্রতিটি দেশের সাংবিধানিক আইনের একটি অংশ হিসেবে মানবাধিকার আইন ক্রমশঃ বিকাশ লাভ করছে। একটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব ভূখণ্ডে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার নাগরিকদের মানবাধিকার প্রদান করে থাকে। ষাটের দশকে যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের দুঃখ দুর্দশার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেই মানবিক আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, বায়াফ্রা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বিশ্ব বিবেককে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য যে আন্দোলন করে তা মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবিক আইন ও মানবাধিকার একে অপরের খুব সন্নিকটে চলে আসে।
মানবিক আইনের বিধানাবলী যুদ্ধের সময় বা আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের সময় শত্রু পক্ষের মানুষকে রক্ষা করে কিংবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সময় বিরোধী দলের সদস্যদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। অপরদিকে, মানবাধিকার সংক্রান্ত বিধানগুলো খুব সীমিতভাবে যুদ্ধের সময় প্রযোজ্য হয়। বস্তুতঃ এ বিধানগুলো অযুদ্ধকালীন ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। কিছু কিছু অধিকার রয়েছে যেগুলো মানবিক আইন ও মানবাধিকার উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়। যেমন- জীবনের প্রতি সকল প্রকার হুমকি নিষিদ্ধ, দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি নিষিদ্ধ, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ এবং ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় নিশ্চয়তার নিরাপত্তা বিধান।
মানবিক আইন ও মানবাধিকারের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ভিন্নতর। মানবিক আইন কার্যকর করার জন্য কোন সুনিদিষ্ট মেশিনারি নেই। যুদ্ধের সময় কোন তৃতীয় পক্ষ বা রেডক্রস যুদ্ধমান এলাকার আহত বা পীড়িতদের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মানবিক আইন বাস্তবায়ন করা হয়। পক্ষান্তরে, মানবাধিকার বিপর্যন্ত হলে তা প্রথমত নিজ রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বলবৎ করার ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব না হলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা যায়। তাছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়েও মানবাধিকার বাস্তবায়নের ব্যবস্থা রয়েছে।